রবিবার, ১২ মে, ২০১৯

মন বারান্দায়


প্রথম পর্ব।


---দেখ্ মামা,পা একবারে আমাদের পায়ের কাছে নিয়ে আসছে।চল লাগিয়ে দেই।
:স্যার বুঝে যাবে।
---আরে,স্যার তো ম্যাথ করাচ্ছে।টেবিলের নিচে বুঝতে পারবে না।
:লামিয়া যদি চিৎকার করে উঠে,হুলস্থুল কাণ্ড হয়ে যাবে। 
---গর্দভ,তোর দ্বারা কিছুই হবে না বলেই জহির লামিয়ার পায়ে ওর পা দিয়ে চিমটি খাটলো।
মাইনাস ফোর পাওয়ারি চশমার কাঁচ ভেদ করে আমার দৃষ্টি বিদ্যুৎের গতিতে সরে যাওয়া একটা পা দেখতে পেল।আমি বার দুয়েক স্যারের দৃষ্টির আড়ালে জহির আর লামিয়ার দিকে থাকালাম,কোন ভাবান্তর নেই!আমি বসছিলাম স্যারের পাশে, আমার পাশে জহির সহ আরও চারটা ছেলে ,আমাদের বিপরীতে একই টেবিলে চারটি মেয়ে পাশাপাশি বসেছে।নবম শ্রেণীতে উঠার শুরু থেকেই আমরা নয়জনের একটা গ্রুপ পাঁচ মাস যাবত স্যারের কাছে পড়ে আসছি। মেয়েরা যাওয়ার কয়দিন পরে আমরাও পড়তে গেলে স্যার এক ব্যাচ ই  সবাইকে পড়াত।কিন্তু কোন ছেলে কোন মেয়ের সাথে কথা বলার সাহস পেত না,যদিও একই স্কুলে পড়তাম।সত্য বলতে কি ওরা এই স্যারের কাছে পড়ছে বলেই আমরা ও শুরু করছি। ওদের আকর্ষণেই প্রাইভেটে যাওয়া।কিন্তু ওদের সাথে কথা বলতে অজানা একটা বাঁধা কাজ করত। ওরা যেন ভিন্ন গ্রহের ভিন্ন ভাষার প্রাণী।তবে মনে মনে সব মেয়ে/ ছেলেই চাইতো,ইস যদি ছেলেদের/মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারতাম।একটা মেয়ের সাথে সামন্য কথা বলা বিরাট ব্যাপারস্যাপার ছিল।জহির টাইপের কোন ছেলে যদি হঠাৎ করে কোন মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাস করার  সাহস দেখাত ,কেমন আছো?হয়ে গেছে, ওই ছেলেকে নিয়েই ক্লাসের সব ছেলে মাতামাতি শুরু করে দিতো।

জহির ছেলেটা ডানপিটে,শয়তানিতে মাস্টার্স করা,আমিও বিদ্যাটা রপ্ত করার ধান্ধায় আছি ,সালামি হিসাবে ২ টাকার একটা পালস  দিলেই সে মহাখুশি।তবে এ বিদ্যাটা সবার চেহারার সাথে যায় না,শত চেষ্টা করেও আমার চেহারায় মানিয়ে নিতে পারি না।কেমন কেমন একটা ইনুসেন্ট ভাব থেকেই যায়। তার কারন ও আছে,আমি ইচ্ছা করলেও ওর মতো সবার সামনে থেকে নারিকেল চুরি করে পালাতে পারবো না।ক্রাশের সাথে কথা বলতে গিয়ে মেয়ের বড় বোনের ঝাঁটার দুলাই থেকে রক্ষার জন্য দৌড়াতে পারব না। কিছু ছেলে আছে মনের ভিতর শত শয়তানির ইচ্ছা থাকলেও,বাহিরে তাকে ভদ্রই দেখাবে।আমি হলাম তেমনই পিচ্চি টাইপের রাঙ্গা চেহারার নিরীহ লাজুক ভদ্র ছেলে। পিচ্চি হলেও ক্লাস রোল এক হওয়ার সুবাধে সবার সুনজরে ছিলাম,অনেকের কাছে অবশ্য ছোটভাই।

লামিয়াকে দেখা যাচ্ছে অনেকটা দূরে,সাথে আরও দুইটা মেয়ে,কুয়াশা ভেদ করে আসছে ‘কারপ্যু   স্যারের’ ম্যাথ প্রাইভেটে। স্কুল থেকে কয়েকমিনিটের হাঁটা পথ।সোনালী কার্প মাছের সাথে মিল বলে সবাই এই নামেই জানে,বাবা মায়ের দেওয়া ভাল নামটা মনে হয় না কেউ জানে,কেউ জানার প্রয়োজনও মনে করে না।পৃথিবীর সবাই অন্যকে নিয়ে মজা নিতে পৈশাচিক আনন্দ পায়, নামি-দামি মানুষ হলে তো কথায় নাই।আজকে ইচ্ছা করেই স্যার থেকে দূরেই বসছি,জহিরের সাথে প্ল্যান করা,আমি পা দিলে মেয়েটি রিয়েকশন দেখব, খেয়াল রাখছি কখন পা এদিকে আনে। পড়া প্রায় শেষের পথে হঠাৎ কালো একটা পা ঠিক আমার জুতার সামনে  নাড়াচাড়া করছে।বুক ধড়ফড় করছে,কখনো কোন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলাম না।কি যে হবে! জহির অনবরত চিমটি কেটে বুঝিয়ে দিচ্ছে,শালার ব্যাটা এখনো বসে আছিস কেন?আমি যে ভীতু না,তার প্রমাণ দিতে হবে।অন্যমনস্কের ভান ধরেই পা টা একটু এগিয়ে দিতেই ওর পায়ের সাথে লেগে গেল।আমি খুব মনোযোগী হওয়ার ভান করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি।কিন্ত আশ্চর্য হলাম কয়েক সেকেন্ড বাদেই,যখন দেখলাম মেয়েটি পা সরানোর কোন চেষ্টায় করছে না।যখন তিন/চার মিনিট ওর পায়ের উপর পা রাখার পরেও পা নেওয়ার কোন নাম নিচ্ছে না,তখন রীতিমতো আমি ভড়কে গিয়েই পা সরিয়ে  নিয়ে আসছি।
 প্রাইভেট শেষে সরাসরি স্কুলের মাঠে পি.টি তে যোগ দিলাম।সবাই যে কেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে বুঝতে পারলাম না,কাকে যেন আমাকে ইশারা করে বলতে শুনলাম;
দেখ,উপরে উপরে যতই না করুক,তলে তলে ঠিকই টেম্পু চালাচ্ছে।
হঠাৎ করে পি.টি স্যারের কথা শুনে আকাশটা মাথায় না ভাঙ্গলেও উপরের নারিকেল গাছটা যে ভেঙ্গেছে সেটার নিশ্চয়তা দিতে পারি;

কিরে,সাকিব?দুই পায়ে দুই-রঙের জুতা কেন?
সবাই হো হো করে হেসে দিল।জুতা দেখে তো আমার মাথাচক্কর দিয়ে উঠছে।এটা কিভাবে সম্ভব! 

__দেখ্,তোর লামিয়া তোর জুতা নিয়ে গেছে।

:আমার লামিয়া মানে!

জহিরের পৈশাচিক আনন্দে বাঁধা দেওয়ার কোন অধিকার আমার নেই।যদিও বাহিরে বাহিরে একটু বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতাম,কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিজেও সেই আনন্দের স্বাদ আস্বাদন করতাম।লামিয়ার রোল সবসময়ই দুই থাকে। তার উপর আমার মত পিচ্চি হোক না সে একটু কালশিটে।দুইজনেই ভাল পড়াশোনা পারতাম বলেই হয়তো কালশিটে হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুদের ঠাট্টায় অনিচ্ছায়  মনের কোণায় ভাবনার একটা অস্থায়ী জায়গা তৈরী হয়ে যেত।

আজকে ক্লাসে কি হবে একথা চিন্তা করতেই এখুনি স্কুল পালাতে ইচ্ছা করছে,কিন্তু এটা সম্ভব না।পি.টি শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাংলা স্যার ক্লাস নিতে চলে আসছে।ক্লাস চলছে,যতটা আশা করছিলাম তার কিছুই অঘটন ঘটে নাই,শুধু মাত্র কয়েকটা ছেলেমেয়ের মুচকি হাসি ছাড়া।  কিন্তু ক্লাস শেষে যেটা হলো সেটার জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না।

আমাকে নিয়ে সব ছেলেই মশকরা করবে, স্বাভাবিক।লামিয়াকে নিয়ে মেয়েরা মাশকরা করবে তাও,স্বাভাবিক।হ্যাঁ,তাই ঘটতেছে।কিন্তু যে মেয়েরা ক্লাসে কোনদিনই ছেলেদের সাথে কথা বলে নি, কথা বলা যেখানে বিশ্ব জয় করার সমতুল্য।হঠাৎ কি এমন হয়ে গেল! আজ সেখানে মেয়েরাই ক্লাসের অন্যসব ছেলেদের সাথে চুপিচুপি কি-সব বলেই হাসাহাসি করছে।তাহলে কি এতোদিন যাবত সবার মনেই একটা অব্যাক্ত বাসনা ছিল,যেটা দরজা খুলে বাহিরে বের হতে পারছিল না,বের হওয়ার দরজা খুঁজছিল,আমার সামান্য জুতা বিনিময় ই কি সেই দরজা খুলে দিয়েছে!   হঠাৎ করে  রুম নিস্তব্ধ,ভাবলাম যাইহোক না কেন  একটা ভাল কাজ ই হয়ে গেছে।এবারের মত তো এঘটনা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নিস্তব্ধ রুমের নীরবতা ছারখার করে  সবাই যখন সোল্লাসে বলা শুরু করল,

দুলাভাই….

আমার কান্না চলে আসছে,ছুঁইলাম না ধরলাম না,দুলাভাই!
সামন্য জিনিস গড়িয়ে গড়িয়ে এতোটা চলে আসবে বুঝতে পারি নাই,বুঝলে আরও আগেই থামিয়ে দিতাম।এমন ইনার-পিস  উপভোগ করতাম না।
 ক্লাস শুরু থেকেই পিছনের বেঞ্চে নীরবে বসে থাকা  নীরা নামের মেয়েটি রাগে গরগর করতে করতে,

---জুতা বদল হয়ছে তো কি হয়ছে,প্রেম এতো সোজা নাকি।সাকিব কি কখনো বলছে যে লামিয়াকে ভালবাসে?তোরা শুধু শুধু ওদের নিয়ে মাতামাতি করতেছোস কেন?
কথাগুলো এমনভাবে বললো যে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সবাই চুপ হয়ে গেল।কেউ কিছু বুঝতে পারল না,নীরা  হঠাৎ এমন করল কেন?ক্লাস শুরু থেকেই খেয়াল করলাম সে আনাদের মজা নিয়ে কোন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে না,বরং রাগে মুখের আকৃতি এমন করে রাখছে,যেকেউ দেখলে ভয় পেয়ে বলে দিবে,’থাক বাবা,আমি আর ওদের নিয়ে মজা নিব না।’

 স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি তার একটা চোখ নষ্ট, কখনও কথা বলি নি।তবে এক চোখ নিয়েই মেয়েটিকে আমার দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকতে দেখতাম।  নীরার চোখের কোণে পানির অস্থিত্ব আমি অনুভব করছি।
   

চলবে….

আবদুল্লাহ নয়ন 

কোন মন্তব্য নেই: