রবিবার, ১২ মে, ২০১৯

কাঁচা আউশ

                                  

          

       এক।




হিরনের কাছে আজ সবকিছু বেসামাল লাগছে।লাগার কথাই,শুক্রবার মানে তার জন্মদিন বলে কথা।প্রসববেদনায় কাতর আয়শা বাথরুমে পিছলে পরে আছে,বাসায় কেউ নেই,একটা পা ভেঙ্গে গেছে,দরজা খুলে বাহিরে বের হওয়া অসম্ভব। মায়ের অন্ধকার ক্ষুদ্র কুপ থেকে বের হয়ে আলোর বদলে বাথরুমের বিশ্রী গন্ধ শুকে সে চিৎকার করে জানিয়েছিল, মা আমি বেঁচে আছি। সেই  থেকে শুক্রবার তার জীবনের আলাদা অধ্যায় হয়ে যায়।         
   
 হাফপ্যান্ট পড়া পিচ্চিটা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কেন্?ও  কি তার অপমানের কথা বুঝতে পেরেছে?আর যারা ওই ঘটনা না দেখছে তাদেরকে   বলে দিবে?
এইমাত্রই তো ঘটনাটা ঘটলো, এইতো বিকালবেলা, এখনো তো সে বাড়িতে যায় নাই,এখনো তো সূর্যদেব তার আলো নিভিয়ে দেয় নাই,এর মাঝেই সবাই জেনে গেছে?এইতো গতকালেই তো এসময় মেয়েটি তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিলো,আজ হঠাৎ করে সব ঘোলাটে হয়ে গেলো কেনো?এই ধোঁয়াটে, নিষ্ঠুর রাস্তায় আর এক মুহূর্তও  দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না।সে হনহন করে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো,মনে হচ্ছে রাস্তার চারপাশ থেকে উৎসুক জনতা তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।রাস্তার দুপাশের ধানক্ষেত গুলাও যেন হেসে হেসে বলছে,বাক্কারে ব্যাটা!

বাড়িতে ঢুকেই তার পা আটকে গেলো,চারদিক তাকিয়ে দেখে নিলো,কেউ তাকে দেখে ফেলছে কি-না। না,কেউ তাকে দেখছে না।সে বাড়ির পিছনদিক দিয়ে বিড়ালের মত পা ফেলে তার ঘরে ঢুকে গেলো। সবেমাত্র দরজার ছিটকিনি আটকিয়ে,বালিশে মুখ গোজে চোখ বন্ধ করে শুয়েছে, এমন সময় বাবার কথা শুনে আঁতকে উঠলো,

...তোমার ছেলেকে পশ্চিম পাড়ায় ঘুরাঘুরি করতে  মানা করো।

:আজব তো!এই বয়সে একটু ঘুরাঘুরি করবে না?

...পড়ার নামে খবর নেই,সারাদিন আতরামি ফাতরামি করে বেড়ায়।ডাক্তার হওয়া  সোজা কথা না।তাড়াতাড়ি হোস্টেলে যেতে বল।

:দেড়মাস পর আসছে,বরিশালে থেকে থেকে ছেলের শরীরটা একবারে কি হয়ে গেছে!বলেই আয়শা ডুকরে কেঁদে উঠে।

আয়নাল সাহেব কোনোকিছু তেই ভয় পায় না একমাত্র আয়শার কান্না ছাড়া।সেই ষোলো -সতেরো বছর বয়সে বাবা-মা, আভিজাত্য সব বিসর্জন দিয়ে তার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলো।লজ্জায় আর কোনোদিন বাড়িতে ফেরার চিন্তা করে নাই।চিন্তা করে নাই বললে ভুল হবে,কতদিন জানালার পাশে বসে আকাশের সচল মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেঘ ঘন থেকে ঘনতর হয়,আকাশের বুক ছিঁড়ে বৃষ্টির ফোঁটা অনবরত ঝরে পড়ে,তার চোখেরজল স্রোতস্বিনী নদীর নকশা অঙ্কন করে।সেই চোখের জলে তার বাবা-মা,ভাই-বোনদের স্নেহ ভালোবাসার স্মৃতি আয়নাল সাহেবের চোখে ঝলসে উঠে।সে তার সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে কিন্তু ওই ভালোবাসা দেওয়ার ক্ষমতা তো সৃষ্টিকর্তা  তাকে দেয় নাই।

হিরনের বুঝতে দেরি হয় না  কাকে নিয়ে কথা হচ্ছে।এসব কথা শুনার ইচ্ছা তার নেই,দরজার ছিটকিনি খুলে আস্তে আস্তে বাড়ির পিছন দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
বাড়ি থেকে বের হয়ে হিরন পুকুরপাড়ে বসে আছে।নামমাত্র পাতা নিয়ে সজিনা  গাছটা ব্যার্থতা স্বীকার করে পানির উপর নুয়ে পড়েছে ।পাশাপাশি দুইটা কাঠাঁল গাছে দুইটা বুলবুলি একে অপরের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।পাশের কদমগাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা টুনটুনি পাখি এটা উপভোগ করছে। হিরন দুই কাঠাঁল গাছের মাঝে বসে  নীরব সাক্ষী  হয়ে আছে। গৌরবর্ণের চেহারায় সন্ধ্যার লালাভ আলো পড়ে তার মুখের আদ্যপ্রান্ত সব  জানিয়ে দিচ্ছে।কাছে গেলে বুঝা যায়,কে যেন তার মুখে সুঁই দিয়ে অসংখ্য গর্ত করে দিয়েছে,যদিও দূর থেকে কারও বুঝার উপায় নেই। দুইএকটা হালকা তিলের ছিটা মুখের সৌন্দর্যকে না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। মোটামুটি  মাংসল শরীর নিয়ে মহা ঝামেলায় আছে কেননা উচ্চতার তুলনায়  চওড়া দেহকে একটু বেশিই চওড়া মনে হয়।মনে হয় না ইহজন্মে কখনো চুলের যত্ন নিয়েছে, সামনে পিছনে সমান চুল গুলি কান আবৃত করে আছে; যত্নের অভাবে চুল গুলি তার নিজস্ব রং পরিবর্তন করে  ধূসর হয়ে যাচ্ছে,এদিকে খেয়াল করার সময় তার নেই কারন তাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। গ্রামের এই ভদ্র, নম্র,সহজ সরল স্বভাবের ছেলেটি মেডিকেলে এসে অনুভব করেছে ,তার ভোঁতা অনুভূতিগুলো ক্রমশ  ধারালো হচ্ছে।

দেড়/দুইমাস আগের ঘটনা এখন সে মনে করতে চাচ্ছে না কিন্তু কেন জানি এটাই বারবার মস্তিষ্কের পিছনে অক্সিপিটাল লোবে আঘাত হানছে। কেননা,কেউ যদি আপনাকে বলে,আপনার অমুক ভাবিকে ‘না-দেখে’ পাঁচমিনিট চোখ বন্ধ করে থাকতে পারবেন? আপনি সাথে সাথে বলে দিবেন,হ্যাঁ পারবো।কিন্তু বন্ধ করলে দেখা যাবে এই পাচঁমিনিটে আপনি তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হদিস পেয়ে গেছেন!ওই যে ‘না-দেখে’ অনিচ্ছাটা আপনার স্পর্শ ইন্দ্রিয়র উপর কল্পনার জাল বুনে কৃত্রিম সক্রিয় ইন্দ্রিয় সৃষ্টি করে দিবে।

ব্যার্থতাকে মেনে নিয়ে অতিরিক্ত একবছর ঘরের কোণায় লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জলে বই ভেজানো ছেলেটি দ্বিতীয় বার সিঁড়ি পাড়ি দিতে গিয়ে পড়ে যায় নি।এবার আর তাকে ঘরে আটকে রাখার সাধ্য কারো নেই।খাঁচাছাড়া পাখির মতো এ গ্রাম,ও গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে।হিরন কোন এক শুক্রবারে  জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে, বিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে, দেউরী ঘেরা একটি বাড়ি থেকে বের হওয়া বৃষ্টিভেজা কাদাময় কাঁচা রাস্তাটি দিয়ে আনমান হয়ে হাঁটছিল।হঠাৎ করে তার পায়ের সাথে অন্য একটি মাংসল পায়ের ল্যাং মারার অস্থিত্ব অনুভব করে,আর নিজেকে আবিষ্কার করে কাদাময় গর্তে দুই পা ছড়িয়ে আরামে বসে আছে।আর তার পাশে  মাঝারি আকৃতির,ছিপছিপে গড়নের,প্যান্টশার্ট পড়া একটি মেয়ে,ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট হাতে নিয়ে,বিড়ালের মত চোখে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে তাকে খুঁটিয়ে খঁটিয়ে দেখছে,আর ফিকফিক করে অনবরত হেসে যাচ্ছে। মেয়েটির চোখ হিরনের চোখে পড়তেই হিরন লজ্জায় অন্যদিকে ঘুরে গেলো,
---“কি মশায়,আপনি কি এভাবেই হাঁটেন?এত অল্পতেই পড়ে গেলেন! দেন,হাত দেন।” বলে মেয়েটি তার হাত বাড়িয়ে দিলো।

প্রথম দেখায় কারো প্রেমে পড়ে যাওয়া পাগলামির লক্ষন।লোকে শুনলে পাগল উপাধি দিয়ে সামাজিক দায়িত্বের খাতিরে  পকেট ভেঙ্গে আপনাকে দিব্যি পাবনায় দিয়ে আসবে। এমনকি হিরনও স্বাচ্ছন্দ্যে এ  গুরুদায়িত্বটুকু পালন করতো।কিন্তু শুক্রবার বলে কথা,হিরনের বিরুদ্ধে যাবে না,তাও কি হয়? 

স্কুল মেইড নিলয়ের কল্যানে মেয়ের নাম,ঠিকানা জানতে দ্বিতীয়দিন অপেক্ষা করা লাগে নাই।সেদিন থেকেই বন্ধু নিলয়কে নিয়ে প্রতিদিন বিকালবেলা পাঁচ গ্রাম পেরিয়ে কাঁচা রাস্তাটির পাশে শিমুলগাছের গুঁড়িতে  বসে আড্ডা দিতো।দূর থেকে প্রায়ই দেখা যেত,ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ডে ইয়ারে পড়ুয়া কেয়া বাচ্চাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে।সে চোখকে ঘুরিয়ে বিভিন্ন  এঙ্গেলে (কখনো ৪৫°,কখনোবা ১৮০°)মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো।যখন কেয়ার চোখের সাথে তার চোখ এক সরলরেখায় এসে যেত,হয়ে যেত তাদের মধ্যে চোখাচোখি, হাসি বিনিময়।ঠিক তখনই, হীরনের ভোঁতা  অনুভুতি গুলো প্রাণ ফিরে পেতো।
হয়তোবা কোনদিন কেয়া খেলায় আসলো না,তার চোখ চলে যেত বাড়ির দেউড়ী ভেদ করে,কোনকিছুর নাড়াচাড়া অনুভব করলেই, বুকের ভিতর কেমন যেন ধক্ করে উঠতো।

   দুই পাটি দাঁত বের করে হি হি হা হা করে হাসতে হাসতে নিলয় বলতে লাগলো,
--- কি কাকা!ব্যাপার কি?আজকাল মেয়ে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলা,কেয়ার ভিতর কি দেখলা?

লজ্জায় হিরনের মুখ রক্তিম হয়ে গেলো।
সে জানে না।আসলেই সে জানে না।মেয়েটির চঞ্চলতা?চটপটে স্বভাব?  তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসি দেওয়া?চোখের চাহনি? নাকি অন্য কিছু? তার মনে জায়গা করে নিয়েছে,সে কিছুই জানে না।
চিরপরিচিত সেই বাড়ি,বাড়ির পাশের কাঁচা রাস্তাটি দিয়ে হাঁটছে,পিছনে পেলে আসছে রাশি রাশি ধূলিকণা।সাদাটে ধূলিকণা কে বিদীর্ণ করে তার  সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি পিছনে ফিরে বাহির বাড়িতে কাউকে দেখতে পাবার আশায় শিমুলবীহিন শিমুলগাছের ছায়ায় দুই বন্ধু  বসে আছে।কিন্তু চার/পাঁচ দিন যাবত মেয়েটির কোনো হদিস পাওয়া গেলো না!
সূর্যদেব যখন তার রথে চড়ে পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে গেলো,ঘরে ঘরে জ্বলে উঠা সন্ধ্যাবাতির ঝিলিক যখন তাদের  চোখে এসে পড়লো;তখন অপেক্ষার প্রহর শেষ করে, আস্তে আস্তে মন খারাপের রথে চড়ে ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে যোগ দিতে বরিশাল চলে আসল।

                             দুই।


এরপর হিরন প্রায় মাস দেড়েক পর ১০ দিনের অটো নিয়ে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে আসে।তার মনের জমানো শত কোটি অনুভূতির প্রকাশ করতে সে দেউরীর ফাঁক দিয়ে উঁকঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু কারো কোন দেখা পাচ্ছে না।কাছাকাছি থেকেও পাচঁ/ছয় দিন যাবত কেয়াকে দেখতে পায় না!
এটা সে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেছে না।মনে হচ্ছে পৃথিবীপতি যত কষ্ট পৃথিবীতে বিলিয়ে দিয়েছে,সব যেন তার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে।এক একটা দিন,মুহূর্ত তার কাছে এক একটা বছরের মত লাগছে।না আছে ঠিকমত খাওয়া, না আছে নাওয়া, ওকে দেখতে পাবার  আশায় কত সকাল,কত দুপুর,কত বিকাল; শিমুলগাছ,বটগাছের  ছায়ায় কাটিয়ে দিয়েছে,তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

---কিরে,কিছুদিন ধরে তুই আনমনা হয়ে ঘুরতেছিস,কিছু হয়েছে?

মুখে ভাত নিয়ে,জানালার বাহিরে তাকিয়ে,ভাতের থালায় এলোমেলো অক্ষর আকঁছে।মায়ের কথায় সে চমকে উঠে-

:কই কিছু হয় নাই তো।

---তো,মুখে ভাত গোজে দিয়ে বসে আছিস কেন?

:কলেজ তো ০২ তারিখ খোলা,আর চার/পাঁচ দিন পরে চলে যেতে হবে।তাই বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে।

ছেলের কথা শুনে মায়ের চোখে পানিজমতে শুরু করছে।সে জানে এখন গেলে দেড় দুই মাসের আগে আর  একমাত্র ছেলেকে দেখতে পারবে না।তবু ছেলের সামনে সে চোখের জলে বুক ভেজাতে চায় না।নীরবে কিছুক্ষন কেঁদে না নিলে, তার কষ্ট কিছুতেই কমবে না। সামনে বসে অপলক দৃষ্টিতে ছেলের খাওয়া দেখছে,

---তোর কাকার বিয়ে ঠিক হয়েছে এপ্রিলের ২৯ তারিখ, জানিস তো?

---হুম।

---তুই তো আর আসতে পারবি না?

---এসময় আমার পরীক্ষা থাকবে।

---তুই আসার কিছুদিন আগে মেয়ে দেখা হয়েছে।মেয়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অনেক সুন্দরী।

মেয়ে দেখা হয়েছে কিনা,কোথায় দেখা হয়েছে,মেয়ে কেমন, কোথায় পড়ালেখা করে;এসব সে শুনতে চায় না।তার মাথার এখন কেয়া চড়কির মতো ঘুরছে। ওকে ছাড়া সে কোনোকিছুই ভাবতে চায় না।সবকিছু তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।মেয়েটি তার স্বপ্নে আসে স্বপ্নকুমারী হয়ে,দুইদিন আগেও তো সে স্বপ্নে দেখেছে,
মেয়েটি এসে তার হাত ধরে বলতেছে,এই ভ্যাবলা ছেলে,তুমি প্রতিদিনেই আমার পিছনে ঘুরঘুর করো কেনো?লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারো কেনো? কিছু বলবে?তুমি কি আমায় ভালবাসো?তাহলে আসো আমরা পালিয়ে যাই,আমার না কারো সাথে পালিয়ে যাওয়ার অনেক সখ।কোনো কথা নাই বার্তা নাই,ওরা পালিয়ে গেল গহীন কোনো জঙ্গলে।গভীর নির্জন জ্যোৎস্না রাতে,তারা হাত ধরাধরি করে চাঁদের দিকে চেয়ে হাটছে,আকাশে কোটি কোটি,একটা একটা তারা গুনছে আর সামনে অগ্রসর হচ্ছে ,সবগুলো তারা গুনে শেষ করার আগে কোন ক্ষমতা নেই তাদের হাতকে আলাদা করার,হঠাৎ একটা আরশোলা দেখে কেয়া চিৎকার করে হিরনকে জড়িয়ে ধরলো।মেয়েটিকে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে যাবে ;এমন সময় মসজিদ থেকে ভেসে আসছে,'আসসলাতু খাইরুম মিনান নাউম।'চোখ মেলে হিরন দেখে,একটা আধমরা  আরশোলা তার  বুকের উপর বিলি কাটছে।

ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু হিরনের অপেক্ষার প্রহর শেষ হবার নয়। অলৌকিক ভাবেই মনে হয় গতকাল কেয়াকে সাইকেল চালিয়ে কলেজ থেকে আসতে দেখেছিল।কেয়া তার দিকে চেয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল!

আজ শুক্রবার,তো কি হয়েছে।আজকেই একটা কিছু করতে হবে।সে ঠিকই মোশাররফ স্যারের হাইয়ার ম্যাথ প্রাইভেট থেকে সাইকেলিং করে আসবে।আশেপাশে কোথাও লালগোলাপ পাওয়া যাচ্ছিলো না,হিরন কেয়ার বাগান থেকেই ফুল চুরি করে এনেছিলো৷ নিলয় চৌরাস্তার মাথায় দাঁড়ানো, নিলয়ের কল পেয়ে হিরন সাইকেলে পেডেল দিলো,কিছুক্ষন যেতেই বিপরীত দিক থেকে মেয়েটির সাইকেল দেখতে পেল।কথা ছিলো ওর সামনে জোরে ব্রেক করবে,কিন্তু হঠাৎ করে তার চোখে  চোখ পরতেই বুকের ভিতর ধক্ করে উঠল।আর চোখ ফেরাতে পারল না। হিরনের সাইকেল টা পাশের পুকুরে পড়তে গিয়েও যেন  পড়ল না।

---কি,মিস্টার?টাস্কি খেলেন নাকি?কথাগুলা বলেই মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে।

হিরন দ্বিধায় পড়ে গেলো।কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না।
:না,মানে.....এ...

---অনেকদিন  ধরে দেখছি,আপনি আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করেছেন। ব্যাপার কি?চুরি  করার ধান্ধা নাকি?একথা বলে সে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হিরন চুরি করা  লাল গোলাপ ফুলটা বুক পকেট থেকে নিয়ে মালিকের বুকের সামনে ধরে, দম টেনে ভয় কাটিয়ে  আমতা আমতা করে দীর্ঘক্ষন যাবত প্র‍্যাক্টিস করা বুলি আওরাতে  শুরু করলো,
:অনেক দিন ধরে ভাবছি এটা আপনাকে দিব,কিন্তু দেওয়ার সুযোগ হয়ে উঠছে না।এটা গ্রহন করলে কৃতার্থ হবো।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ফুলটি নিলো, অনেক সময় নিয়ে গন্ধ শুকলো,
---ফুলের গন্ধটা ভাল,মনে হচ্ছে আমার বাগানের।আপনার নাম হিরন,না?
কথাগুলো বলে মিটিমিটি হাসছে।

হিরন যেন আকাশ থেকে গাছের ডালে পড়ে চ্যাংদোলা খেয়েছে,মেয়েটি তার নাম জানলো কিভাবে!নাম জানা কি তার কথা!সে তাকে চিনে!!!
:হুম,আপনি জানলেন কিভাবে?

---জানতে হয় মশায়,আপনার কাকার নাম জেনো কি?

কাকার নাম!!হিরনের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে,কোথা হতে অন্ধকার এসে তার চোখ বুজিয়ে  দিচ্ছে,অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বললো,
:ডা.ইলিয়াস

নামটি শুনেই হিরনের দিকে চোখ টিপে মিটিমিটি হেসে সাইকেলে পেডেল দিলো।

হিরন শুধু নির্বাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে সচল সাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিশাল ডিম্বাকার পৃথিবী ক্রমশ সরু হয়ে অসীম  রাস্তা হয়ে যাচ্ছ, আর সে রাস্তায় সাইকেল চলছে অসম্ভবের পথে।সে পথে পাড়ি দেওয়ার সাহস তার ইহজন্মেও হবে না।


আবদুল্লাহ নয়ন 





কোন মন্তব্য নেই: