রবিবার, ১২ মে, ২০১৯

ক্ষুদ্র দৃষ্টি




নিজ জেলার সংস্কৃতির গন্ডি পেরিয়ে অন্য জেলার সংস্কৃতি, চালচলনের সাথে পরিচিত হওয়ার বাসনা পিচ্চিকাল থেকেই ছিল।সাথে সাথে এই বিশ্বাসও ছিল, এটা নিছক স্বপ্ন মাত্র যা কখনও পূর্ণ হওয়ার নয়।তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি,স্কুল থেকে পিকনিকে যাচ্ছে শেরপুরের কি একটা পাহাড়ি এলাকায়,আমি তো মহাখুশি, পাহাড় দেখব। জীবনে কখনও দেখি নি,পাশের বাড়ির মতি চাচার কাছ থেকে শুনতাম,চট্টগ্রামে ইয়া বড় বড় পাহাড় আছে,সমুদ্রে ইয়া বড় বড় নীলতিমির বসবাস,তারা নাকি মানুষ ও গিলে খেয়ে পেলে।পড়াশোনা বাদ দিয়ে তার পিছন পিছন ঘুরঘুর করতাম,পাহাড়ি রোমাঞ্চকর ঘটনা শুনার জন্য।বৃষ্টির দিনে টিনের চালের বারান্দার নিচে আমরা কয়েকজন গোল হয়ে মতি চাচাকে ধরতাম,আজকে একটা গল্প বলতেই হবে।মতি চাচা দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রামে ছিল,তার ভাতিজা খায়ের আমার বন্ধু।চাচার সাথে থাকার সুবাদে খায়েরও অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা জানত।খায়ের ও অনেক ভাল  গল্প বলতে পারে,মতি চাচার অবর্তমানে বাদলার দিনে খায়েরের খড়ের চালার গোয়াল ঘরে কাঁঠালের বীচি দিয়ে বানানো ছক্কার লুডু নিয়ে বসতাম,চলত ষোলকটি,পাইট  খেলার আসর,সাথে সাথে মুখে মুখে  অনবরত চলত রোমাঞ্চকর গল্প বলা।বাকি বন্ধুরা সবাই কিছু না কিছু রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা বললেও,আমি শুধু শুনে যেতাম।আমার জীবনে গল্প বলার মতো কোন ঘটনা কখনও ঘটে নাই। তাই যখন শুনলাম স্কুল থেকে পিকনিকে যাচ্ছে,সেইসব শুনা গল্পগুলো আমার মন থেকে ছিটকে বের হয়ে আসতে লাগলো ।যাহোক এবার থেকে আমিও ওদের গল্প শুনাতে পারবো!স্কুল থেকে ফেরার পথে সারাটা রাস্তা পিকনিকের কল্পনা করে আসছিলাম,দুইটা বাস যাচ্ছে।আমাকে জানালার পাশে  সিট নিতেই হবে,খায়েরকে বলতে শুনছিলাম,"ব্যাটা,চলতি বাসের জানালা দিয়ে যখন  রাস্তার পাশের বাড়িঘর, গাছপালার দিকে তাকাবি,দেখবি এগুলো  আপনা আপনিই  পিছনে চলে যাচ্ছে , আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখিস ওরাও চলাফেরা করে।"
গাছপালাও চলতে পারে! আবাক করা ঘটনাগুলো স্বচক্ষে দেখতেই হবে।ভোরে গিয়ে জানালার পাশে বসতে হবে।পাহাড়ে গিয়ে কি করবো, কিভাবে উঠবো, পাহাড়ি মোরগ কি খেতে পারবো?এইসব নানাবিধ চিন্তাভাবনা করে বাড়ি ফিরলাম।

আর কাউকে ভয় না পেলেও বাবাকে প্রচন্ড রকমের ভয় পেতাম।কেন যে ভয় পেতাম,জানি না।এমন না যে মারধর করতো,তবুও কেন জানি তার চোখের দিকে তাকালেই কেমন একটা ভয় মনে ভর করত।রাতে খাওয়ার সময় বাবাকে বললাম,
:বাবা,স্কুল থেকে পিকনিকে শেরপুর যাচ্ছে,আমিও যাব।

...তুই এখনো অনেক ছোট, হারিয়ে যাবি।যাওয়ার দরকার নেই।

:স্কুলের সবাই যাচ্ছে,স্যার ম্যাডামরাও যাচ্ছে।সবার সাথে থাকব।হারাবো কেন?

...এখন যাওয়ার দরকার নেই,বড় হয়ে যাবি।

স্কুলে অন্যদের থেকে উচ্চতায় অনেক ছোট ছিলাম।শুধু মাত্র ছোট হওয়ার জন্যে,হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে,পাহাড় দেখার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো,বাস্তবে রূপ নেওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখাল না।ছোটদের কি স্বাদ আহ্লাদ বলতে কিছু নেই,সারাজীবন তারা গল্প শুনেই যাবে!কখনো শুনাতে পারবে না?কখনো গল্প বানাতে পারবে না?সেদিন সারারাত কান্না করে নিয়তিকে মেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।

ছেলেটা এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে।প্রায় ই দেখা যায় খায়েরের কাছে বসে থাকে,কি সব গল্পগুজব শুনে। এসব গল্পগুজব শোনার ইচ্ছা টা নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেছে,অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্য জেলার সংস্কৃতি জানার বদলে নিজের এলাকার সংস্কৃতি বুকে আগলে সংসার ধর্ম করছি। আজ রাতে খাওয়ার সময় বায়না ধরে বসল,
...বাবা, ১৫০০ টাকা দেও,স্কুল থেকে কক্সবাজার ট্যুরে যাচ্ছে।আমিও যাব।

ছেলেকে কি বুঝ দিব,বুঝে পাচ্ছি না।দেনার দায়ে ব্যাংকের কাছে বাড়ি বন্ধক,মাহিমের মা ও এ খবর জানে না,ইচ্ছা করেই বলি নাই।শুধু শুধু টেনশন করবে।সামন্য বেতনের চাকরিটাও চলে গেল, ফেইসবুক গ্রুপে  একটা ভিডিও দেওয়ার জন্য।ভিডিও তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বস একটা মহিলার কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছে।কার চাকরি যাওয়ার কথা,আর কার চাকরি গেল! এটাই তো বাস্তবতা। নোন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা, আর ছেলে করবে বিলাসিতা!
...বাবা,কি বলসি শুনছো?টাকা কিন্তু দিতেই হবে।বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে।

:তুই এখনো ছোট হারিয়ে যাবি,যাওয়ার দরকার নেই।বড় হয়ে যাবি।
কথা টা বলেই তার বাবার কথাগুলো মনে পড়ে গেল।সে এটা কি বলল!

...কে বলছে আমি ছোট?এই দেখো,তোমার থেকেও লম্বা।

আবদুল্লাহ নয়ন 

কোন মন্তব্য নেই: