সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভাতঘুম




                                                                                           নতুন টিউশনি টা কোনভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না,এর আগেও দুইটা টিউশনি ইগোর খপ্পরে নাই হয়ে গেছে।ইগোকে বিসর্জন দিয়ে ওদের ফোনকলের আশায় না থেকে নিজেই আগ বাড়িয়ে কল দিলাম। তিনটা দুই টাকার নোট পাই পাই করে গুনে দিয়ে শার্ট টা ইস্ত্রি করে গায়ে দিয়েছি,কুঁচকে যাওয়া কফি কালারের গ্যাবার্ডিন প্যান্টে পা ঢুকিয়ে দিলাম,হাত দিয়ে অনেক ঘষামাজার পরেও অনেকটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে,ঘুমন্ত রুমমেটের বডি স্প্রে বগল দেশে চালান করে দিয়ে নিজের ছেঁড়া স্যান্ডেল রেখে তার নতুন কেনা  বাটার বক্স-স্যান্ডেল নিয়ে উধাও হয়ে গেলাম।

শহুরে দালানের বেড়াজালের খপ্পরে পড়ে বাংলা সনের হিসাব টা  প্রায়ই এলোমেলো হয়ে যায়।সাদা মেঘের আড়ালে ঝাপসা নীল আকাশ থেকে খসে পড়া বিকেলের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটছি।তবে রাস্তার পাশে কুকুরের লীলা দেখে অনায়াসে বলে দেওয়া যায় এটা ভাদ্র মাস।

মাদী কুকুরের যৌনাঙ্গে পালা করে মুখ শুঁকে যাচ্ছে দুইটা বড় আকারের মর্দা কুকুর,অন্য একটা খাটো সাইজের কুকুর কয়েকবার চক্কর দিয়েও কাছে ভিড়তে ব্যার্থ হয়েছে।হয়তো    "ছোট জিনিস" কুকুরীর পছন্দ না বলে বড় মর্দা দের লাগিয়ে দিয়েছে ও যেন কাছে ভিড়তে না পারে।কিন্তু কুকুরী যে খাটো কুকুরটার থেকেও খাটো এটা নিয়ে কোন হৈচৈ নেই,দিব্যি দুইটা ইয়া বড় মর্দা কুকুর ঠিকই সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে।বেচারা দূরে দাঁড়িয়ে লালসার লালা ফেলে যাচ্ছে।কপালপোড়া কুকুরটাকে দেখে  মায়া লাগছে,তার চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে কুকুরীর উপর।

রাগটা বর্গের সমানুপাতিক হারে গিয়ে পড়ছে কিছু লম্বা/সৌন্দর্য  বিলাসী মনুষ্য জাতির উপর।৪ফুট ৮ইঞ্চির একটা মেয়েও দাবি করে তার বফ হবে জনি সিন্সের মতো তুখোড় খেলোয়াড়, এতে মেয়েটার কোন দোষ নেই,লম্বা ছেলেটি ই তার ডিমান্ড বাড়িয়ে দিয়েছে।মেয়েটির তাতে কিছুই যায় আসে না,কিন্তু ৫ফিটের ছেলেটির বাজেটে ঠিকই হাত পড়ে।তার সম আকৃতির বন্ধন বিহীন  মেয়ে খুঁজে পাওয়ায় ভার হয়ে যায় যদিও বা পাওয়া যায় ছেলেটি চলে যায় মেয়েটির এক্সপেকটেশনের বাহিরে।

তার থেকে লম্বা মেয়ের হাত ধরে পাশাপাশি হাটলে যতটা না বেমানান দেখাবে, সমাজ তার চেয়েও বেশি হাস্যকর বানিয়ে দিবে,সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটিই বা কেন উদ্ভিদ প্রজাতির মতো তার চেয়ে খাটো ছেলেটির পাশে হাটবে?সবাই দেহের মূল্য দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে যেখানে মনের মূল্য দেওয়ার মতো ন্যূনতম সময় কারো নেই। খাটো/কালো মানুষের প্রতি অবহেলা দেখতে দেখতে মানুষের কাছাকাছি থাকা কুকুরগুলো নিজেদের মধ্যে সে পন্থা চালু করে দিয়েছে।

আরে! খাটো/লম্বা হওয়া,কালো/সাদা হওয়া কি কারো ইচ্ছা নির্ভর!সব তো সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তা'লার হাতের খেলা,উপরওয়ালা ই তো ইচ্ছা করে তাকে এমন আকৃতি দিয়ে বানিয়েছে, উপরওয়ালার খেলার মাশুল কেন খাটো /কালো কুকুরকে দিতে হবে?ভাদ্র মাসের ভেপসা গন্ধ নাকে  ঠেকে,বৈষম্য ঘেরা কুকুরগুলো কে পিছনে ফেলার জন্য পিচঢালা রাস্তা মাড়িয়ে নতুন জুতার তলা ক্ষয় করতে করতে সামনে এগিয়ে গেলাম নিজের দাম্ভিকতা নিয়ে।

আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না,বাস্তবতায় মায়া বলে কিছু নেই যেটা আছে কুকুরটাকে উল্টাপাল্টা কয়েকটা লাত্থি দিয়ে এখান থেকে বিদায় করা।সামান্য যৌনলালসার জালে আঁটকে  পিছনে ঘুরঘুর করে কেন নিজের পার্সোনালিটি  হারাবে?তুমি খাটো হও বা কালো হও অন্যের কাছে যতই অবহেলার পাত্র হও না কেন,উপরওয়ালা তোমার মস্তিষ্কে মশলা দিয়েই পাঠিয়েছে।নিজের পার্সোনালিটি আরেকজনের পাছায় না ঢেলে,হাঁটতে হবে নিজের রাস্তায়,দেখাতে হবে তোমার মস্তিষ্কের কারসাজি, তোমার যোগ্যতা।

সচরাচর আমি যে অটোতে উঠি তাতে কোন মেয়ে উঠে না,মাঝেমধ্যে যারা উঠে, আমার পাশে বসে মাড়ি বের করে রসালো আলাপ জমায়, তারা ঠাকুরমার ঝুলির বুড়ি।যে অটোতে মেয়ে থাকে সেই অটোতে উঠার ধান্ধা করেও আশানুরূপ কোন ফল পাওয়া যায় না।যেটা হয়  টিউশনির সময়টা অর্ধেক রোদে দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়।কিন্তু আজ গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাবের গোলমালের বদৌলতে  সুন্দরী মেয়ে আমার পাশের সিটে!

-মামা,দশ টাকার নোট দিলাম,পাঁচ টাকা ফেরত দেন।

>ভাড়া দশ টাকা, বলা লাগে না।

-প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিয়ে যাওয়া আসা করি,আর আজকে আপনি দশ বানিয়ে দিলেন কেমনে!

মেয়েটি ভাড়া নিয়ে অটোওয়ালার সাথে ভালই বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ছে,ড্রাইভারের হাতে টাকা পড়েছে,এতো সহজে ছাড়ার কথা না।
আমার কাছে ৫ টাকার নোট আছে,মুখে হাসির রেখা এনে ৫টাকার ছ্যাড়াব্যাড়া নোটটা বাড়িয়ে দিলাম,
:মামা,ভাড়া নেন।

>আরও ৫ টাকা দেন,চরপাড়া থেকে টাউনহল পর্যন্ত ভাড়া দশ টাকা।

:এটা নতুন বাজার,আর এখানে ভাড়া ৫ টাকা ই।

পাশের মেয়েটি হঠাৎ করে কাঁদোকাঁদো গলায় বলতে লাগল,
-এক জায়গায় দুইরকম ভাড়া নিতেছেন কেন?

খুব সম্ভবত মেয়েটি টাকা ভুলে বাসায় রেখে এসেছে,সাইড ব্যাগে যা ছিল খুঁজে খুঁজে অনেক কষ্টে বের করেছে।না হলে ৫ টাকার জন্য কোন মেয়ে গাড়িওলার সাথে এমন করবে না।মনে হয় বাসায় যাওয়ার এই ৫টাকায় তার শেষ সম্বল।  মেয়েটির বৈধ ৫টাকা তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলে ভাল লাগতো।

মেয়েটি কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,আমিও ৫টাকার বেশি দিতে রাজি না,আমার কনফিডেন্স দেখে সেও জোরালভাবে আবদার জানাল ৫ টাকা দেওয়ার জন্য।
মেয়েটির টাকা উদ্ধার করে দেওয়া তো দূরের কথা, ড্রাইভার যে আচরণ করছে উল্টো আমার নাকি আবার ৫ টাকা দিতে হয়।

:চরপাড়া থেকে নতুন বাজার ভাড়া ৫টাকা এটা বলতে হয় না,আপনি উনার ৫টাকা ফেরত দিন।

>আপনি নতুন বাজারের কথা বলে উঠেন নি,তাহলে ১০ টাকা বলে তুলতাম।এখন টাউন হলের ভাড়াই দিতে হবে।

-কিন্তু আমি তো উঠার সময় নতুন বাজারের কথা বলে উঠছি,তখন তো ১০ টাকার কথা বলেন নি,আমার টাকা ফেরত দেন না কেন?

মেয়েটির কথা শুনে ড্রাইভার নিজেই নিজের জালে আটকে পড়ল।
ড্রাইভার কিছুই বলছে না,উলটো আমাকে ৫টাকা দেওয়ার জন্য রাগ দেখাচ্ছে,

:আগে উনার টাকা দিন,পরে আপনার টাকা দিচ্ছি।

মেয়েটিকে বাধ্য হয়েই ড্রাইভার টাকা ফেরত দিয়েছে।
ড্রাইভার রাগে কিড়মিড় করছে,

>এবার,আপনি দশ টাকা দেন।

:নতুন বাজার ভাড়া ৫টাকা,১০ টাকা নিতে হলে উঠার সময় বলে তুলতে হয়।উনি উঠার সময় নতুন বাজারের কথা বলে উঠেছিল,কিন্তু আপনি তখন ১০ টাকা ভাড়ার কথা বলেননি,বললে আমি নেমে যেতাম।তাই আপনার ভাড়া ৫ টাকাই নিতে হবে,কিছুই করার নেই।

আমার কথা শুনে মেয়েটি মিটমিট করে হাসতে লাগল।বাধ্য হয়েই টাকা ছাড়াই অটোওয়ালার চলে যেতে হল।

-দেখছেন,গাড়ীর একটা মানুষ ও কোন কথা বলেনি। তারা খুব মজা পাচ্ছিল।

:এটাই বাস্তবতা, অটোওয়ালার সাথে মারামারি করি নি বলে ওরা একটু বিরক্ত হয়েছে।

দাঁড়িয়ে আছি পাঁচতলার সবুজ রঙের বাসার সামনে। অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছি,কেউ খুলছে না।মনে হচ্ছে কেউ সারাজীবনের রাগ চিৎকারের উপর ঢেলে দিয়ে বলছে,
-কে...?
কি পরিচয় দিব বুঝতে পারছি না,তাই দাঁড়িয়ে রইলাম সটান হয়ে।
দরজা খুলে যে মেয়েটি বেরিয়ে এল তাকে দেখ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।

-আপনি আমাকে ফলো করে বাসা পর্যন্ত চলে আসছেন!আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়।

:যদি ভুল না হয়ে থাকে,এই বাসায় কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছিলাম,কেউ একজন জীববিজ্ঞান প্রাইভেট পড়বে।আমাকে আসতে বলা হয়ছিল।

-সরি,স্যার।আমিই আপনার...

~কিরে কবির,এই ভরা দুপুর রোদে বিচালির উপর শুয়ে বিড়বিড় করতেছোস কেন?মাঠে অনেক ধান পড়ে আছে,এগুলো আনতে হবে,তাড়াতাড়ি উঠ।

:যাও তো মা,একটু পরে আসতেছি।

~Abdullah Nayon

কোন মন্তব্য নেই: