সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভাতঘুম




                                                                                           নতুন টিউশনি টা কোনভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না,এর আগেও দুইটা টিউশনি ইগোর খপ্পরে নাই হয়ে গেছে।ইগোকে বিসর্জন দিয়ে ওদের ফোনকলের আশায় না থেকে নিজেই আগ বাড়িয়ে কল দিলাম। তিনটা দুই টাকার নোট পাই পাই করে গুনে দিয়ে শার্ট টা ইস্ত্রি করে গায়ে দিয়েছি,কুঁচকে যাওয়া কফি কালারের গ্যাবার্ডিন প্যান্টে পা ঢুকিয়ে দিলাম,হাত দিয়ে অনেক ঘষামাজার পরেও অনেকটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে,ঘুমন্ত রুমমেটের বডি স্প্রে বগল দেশে চালান করে দিয়ে নিজের ছেঁড়া স্যান্ডেল রেখে তার নতুন কেনা  বাটার বক্স-স্যান্ডেল নিয়ে উধাও হয়ে গেলাম।

শহুরে দালানের বেড়াজালের খপ্পরে পড়ে বাংলা সনের হিসাব টা  প্রায়ই এলোমেলো হয়ে যায়।সাদা মেঘের আড়ালে ঝাপসা নীল আকাশ থেকে খসে পড়া বিকেলের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটছি।তবে রাস্তার পাশে কুকুরের লীলা দেখে অনায়াসে বলে দেওয়া যায় এটা ভাদ্র মাস।

মাদী কুকুরের যৌনাঙ্গে পালা করে মুখ শুঁকে যাচ্ছে দুইটা বড় আকারের মর্দা কুকুর,অন্য একটা খাটো সাইজের কুকুর কয়েকবার চক্কর দিয়েও কাছে ভিড়তে ব্যার্থ হয়েছে।হয়তো    "ছোট জিনিস" কুকুরীর পছন্দ না বলে বড় মর্দা দের লাগিয়ে দিয়েছে ও যেন কাছে ভিড়তে না পারে।কিন্তু কুকুরী যে খাটো কুকুরটার থেকেও খাটো এটা নিয়ে কোন হৈচৈ নেই,দিব্যি দুইটা ইয়া বড় মর্দা কুকুর ঠিকই সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে।বেচারা দূরে দাঁড়িয়ে লালসার লালা ফেলে যাচ্ছে।কপালপোড়া কুকুরটাকে দেখে  মায়া লাগছে,তার চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে কুকুরীর উপর।

রাগটা বর্গের সমানুপাতিক হারে গিয়ে পড়ছে কিছু লম্বা/সৌন্দর্য  বিলাসী মনুষ্য জাতির উপর।৪ফুট ৮ইঞ্চির একটা মেয়েও দাবি করে তার বফ হবে জনি সিন্সের মতো তুখোড় খেলোয়াড়, এতে মেয়েটার কোন দোষ নেই,লম্বা ছেলেটি ই তার ডিমান্ড বাড়িয়ে দিয়েছে।মেয়েটির তাতে কিছুই যায় আসে না,কিন্তু ৫ফিটের ছেলেটির বাজেটে ঠিকই হাত পড়ে।তার সম আকৃতির বন্ধন বিহীন  মেয়ে খুঁজে পাওয়ায় ভার হয়ে যায় যদিও বা পাওয়া যায় ছেলেটি চলে যায় মেয়েটির এক্সপেকটেশনের বাহিরে।

তার থেকে লম্বা মেয়ের হাত ধরে পাশাপাশি হাটলে যতটা না বেমানান দেখাবে, সমাজ তার চেয়েও বেশি হাস্যকর বানিয়ে দিবে,সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটিই বা কেন উদ্ভিদ প্রজাতির মতো তার চেয়ে খাটো ছেলেটির পাশে হাটবে?সবাই দেহের মূল্য দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে যেখানে মনের মূল্য দেওয়ার মতো ন্যূনতম সময় কারো নেই। খাটো/কালো মানুষের প্রতি অবহেলা দেখতে দেখতে মানুষের কাছাকাছি থাকা কুকুরগুলো নিজেদের মধ্যে সে পন্থা চালু করে দিয়েছে।

আরে! খাটো/লম্বা হওয়া,কালো/সাদা হওয়া কি কারো ইচ্ছা নির্ভর!সব তো সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তা'লার হাতের খেলা,উপরওয়ালা ই তো ইচ্ছা করে তাকে এমন আকৃতি দিয়ে বানিয়েছে, উপরওয়ালার খেলার মাশুল কেন খাটো /কালো কুকুরকে দিতে হবে?ভাদ্র মাসের ভেপসা গন্ধ নাকে  ঠেকে,বৈষম্য ঘেরা কুকুরগুলো কে পিছনে ফেলার জন্য পিচঢালা রাস্তা মাড়িয়ে নতুন জুতার তলা ক্ষয় করতে করতে সামনে এগিয়ে গেলাম নিজের দাম্ভিকতা নিয়ে।

আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না,বাস্তবতায় মায়া বলে কিছু নেই যেটা আছে কুকুরটাকে উল্টাপাল্টা কয়েকটা লাত্থি দিয়ে এখান থেকে বিদায় করা।সামান্য যৌনলালসার জালে আঁটকে  পিছনে ঘুরঘুর করে কেন নিজের পার্সোনালিটি  হারাবে?তুমি খাটো হও বা কালো হও অন্যের কাছে যতই অবহেলার পাত্র হও না কেন,উপরওয়ালা তোমার মস্তিষ্কে মশলা দিয়েই পাঠিয়েছে।নিজের পার্সোনালিটি আরেকজনের পাছায় না ঢেলে,হাঁটতে হবে নিজের রাস্তায়,দেখাতে হবে তোমার মস্তিষ্কের কারসাজি, তোমার যোগ্যতা।

সচরাচর আমি যে অটোতে উঠি তাতে কোন মেয়ে উঠে না,মাঝেমধ্যে যারা উঠে, আমার পাশে বসে মাড়ি বের করে রসালো আলাপ জমায়, তারা ঠাকুরমার ঝুলির বুড়ি।যে অটোতে মেয়ে থাকে সেই অটোতে উঠার ধান্ধা করেও আশানুরূপ কোন ফল পাওয়া যায় না।যেটা হয়  টিউশনির সময়টা অর্ধেক রোদে দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়।কিন্তু আজ গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাবের গোলমালের বদৌলতে  সুন্দরী মেয়ে আমার পাশের সিটে!

-মামা,দশ টাকার নোট দিলাম,পাঁচ টাকা ফেরত দেন।

>ভাড়া দশ টাকা, বলা লাগে না।

-প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিয়ে যাওয়া আসা করি,আর আজকে আপনি দশ বানিয়ে দিলেন কেমনে!

মেয়েটি ভাড়া নিয়ে অটোওয়ালার সাথে ভালই বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ছে,ড্রাইভারের হাতে টাকা পড়েছে,এতো সহজে ছাড়ার কথা না।
আমার কাছে ৫ টাকার নোট আছে,মুখে হাসির রেখা এনে ৫টাকার ছ্যাড়াব্যাড়া নোটটা বাড়িয়ে দিলাম,
:মামা,ভাড়া নেন।

>আরও ৫ টাকা দেন,চরপাড়া থেকে টাউনহল পর্যন্ত ভাড়া দশ টাকা।

:এটা নতুন বাজার,আর এখানে ভাড়া ৫ টাকা ই।

পাশের মেয়েটি হঠাৎ করে কাঁদোকাঁদো গলায় বলতে লাগল,
-এক জায়গায় দুইরকম ভাড়া নিতেছেন কেন?

খুব সম্ভবত মেয়েটি টাকা ভুলে বাসায় রেখে এসেছে,সাইড ব্যাগে যা ছিল খুঁজে খুঁজে অনেক কষ্টে বের করেছে।না হলে ৫ টাকার জন্য কোন মেয়ে গাড়িওলার সাথে এমন করবে না।মনে হয় বাসায় যাওয়ার এই ৫টাকায় তার শেষ সম্বল।  মেয়েটির বৈধ ৫টাকা তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলে ভাল লাগতো।

মেয়েটি কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,আমিও ৫টাকার বেশি দিতে রাজি না,আমার কনফিডেন্স দেখে সেও জোরালভাবে আবদার জানাল ৫ টাকা দেওয়ার জন্য।
মেয়েটির টাকা উদ্ধার করে দেওয়া তো দূরের কথা, ড্রাইভার যে আচরণ করছে উল্টো আমার নাকি আবার ৫ টাকা দিতে হয়।

:চরপাড়া থেকে নতুন বাজার ভাড়া ৫টাকা এটা বলতে হয় না,আপনি উনার ৫টাকা ফেরত দিন।

>আপনি নতুন বাজারের কথা বলে উঠেন নি,তাহলে ১০ টাকা বলে তুলতাম।এখন টাউন হলের ভাড়াই দিতে হবে।

-কিন্তু আমি তো উঠার সময় নতুন বাজারের কথা বলে উঠছি,তখন তো ১০ টাকার কথা বলেন নি,আমার টাকা ফেরত দেন না কেন?

মেয়েটির কথা শুনে ড্রাইভার নিজেই নিজের জালে আটকে পড়ল।
ড্রাইভার কিছুই বলছে না,উলটো আমাকে ৫টাকা দেওয়ার জন্য রাগ দেখাচ্ছে,

:আগে উনার টাকা দিন,পরে আপনার টাকা দিচ্ছি।

মেয়েটিকে বাধ্য হয়েই ড্রাইভার টাকা ফেরত দিয়েছে।
ড্রাইভার রাগে কিড়মিড় করছে,

>এবার,আপনি দশ টাকা দেন।

:নতুন বাজার ভাড়া ৫টাকা,১০ টাকা নিতে হলে উঠার সময় বলে তুলতে হয়।উনি উঠার সময় নতুন বাজারের কথা বলে উঠেছিল,কিন্তু আপনি তখন ১০ টাকা ভাড়ার কথা বলেননি,বললে আমি নেমে যেতাম।তাই আপনার ভাড়া ৫ টাকাই নিতে হবে,কিছুই করার নেই।

আমার কথা শুনে মেয়েটি মিটমিট করে হাসতে লাগল।বাধ্য হয়েই টাকা ছাড়াই অটোওয়ালার চলে যেতে হল।

-দেখছেন,গাড়ীর একটা মানুষ ও কোন কথা বলেনি। তারা খুব মজা পাচ্ছিল।

:এটাই বাস্তবতা, অটোওয়ালার সাথে মারামারি করি নি বলে ওরা একটু বিরক্ত হয়েছে।

দাঁড়িয়ে আছি পাঁচতলার সবুজ রঙের বাসার সামনে। অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছি,কেউ খুলছে না।মনে হচ্ছে কেউ সারাজীবনের রাগ চিৎকারের উপর ঢেলে দিয়ে বলছে,
-কে...?
কি পরিচয় দিব বুঝতে পারছি না,তাই দাঁড়িয়ে রইলাম সটান হয়ে।
দরজা খুলে যে মেয়েটি বেরিয়ে এল তাকে দেখ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।

-আপনি আমাকে ফলো করে বাসা পর্যন্ত চলে আসছেন!আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়।

:যদি ভুল না হয়ে থাকে,এই বাসায় কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছিলাম,কেউ একজন জীববিজ্ঞান প্রাইভেট পড়বে।আমাকে আসতে বলা হয়ছিল।

-সরি,স্যার।আমিই আপনার...

~কিরে কবির,এই ভরা দুপুর রোদে বিচালির উপর শুয়ে বিড়বিড় করতেছোস কেন?মাঠে অনেক ধান পড়ে আছে,এগুলো আনতে হবে,তাড়াতাড়ি উঠ।

:যাও তো মা,একটু পরে আসতেছি।

~Abdullah Nayon

শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৯

    অব্যক্ত ভালবাসা        
       
                               
         



                                                                               একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধা মহিলাকে যতটা ঘৃণা করতাম হয়তো গ্রামে আর কাউকে এতোটা ঘৃণা করিনি।

কাচারি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালে একটা অর্ধ নিস্তেজ বাড়ি চোখের সামনে ভেসে উঠে।আরও স্পষ্ট হয় যখন ঘর থেকে গুটিকয়েক পা এগিয়ে পুকুর পাড়ে রেইনট্রি গাছের ভাসমান মূলের উপর বসে ধানক্ষেতে নির্মল বাতাসে কানায় কানায় পূর্ণ বোতল এক নিমেষে খালি করতে বসি। তাকিয়ে থাকি বাড়িটার দিকে,পিচ্চিকাল থেকে দেখে আসা সে বাড়ি।দুই বুড়া-বুড়ি বাহারি নাম নিয়ে এখনো দিব্যি কষ্টের জীবন পার করে যাচ্ছে।তারা স্বামী স্ত্রী নয়, রেষারেষি করে ঠিকে থাকা দুই ভাই বোন।

বড় বোনের প্রচলিত নাম হুইল্ল্যার মা,ছয় মেয়ে এক ছেলের মা'য়ের বড় মেয়েটি হালকা কিছু নিয়েই মুখ গুমরা করে ফুলেফেঁপে থাকত। এর পর থেকেই অন্যের বাড়িতে কাজ করা মহিলাটি তার বিখ্যাত পদবি নিয়ে এখনো বেঁচে আছে।বিখ্যাত না বলে একে ঠোঁখ্যাত বললেও খারাপ শুনায় না।পাড়ায় প্রত্যেক ছেলে বুড়োর ঠোঁটের আগায় এ নাম শোভা পেত।পিচ্চিকালে পুকুরে গোসল করার সময় আমরা সবাই একটা কমন মজা নিতাম, মাথা,পিঠ, পা পানির নিচে দিয়ে নগ্ন পাছা পানির উপরে পালাক্রমে ভাসিয়ে  সুঁই দিয়ে কাঁথা সেলাই করার মতো সামনে  এগিয়ে যেতাম,আর মুখে মুখে বলতাম,"হুইল্ল্যার মার কাঁথা সেলাই।"এমন না যে এলাকায় শুধু হুইল্ল্যার মা'ই কাঁথা সেলাই করত,তবুও কেমনে যে হুইল্ল্যার মা'র কাঁথা সেলাই করার প্রচলন হল জানি না, এগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে পাওয়া।

ছোট ভাই দুইক্ষ্যা দাদার ভাল নাম দুখু মিয়া।জন্ম দিয়ে মা মারা যায় বলে সবাই তাকে দুইক্ষ্যা বলে ডাকে।বড়দের থেকে ছোটদের সাথেই তার অগাধ মিল, হয়তো ৪ ফিট উচ্চতার দুখু মিয়া ছোটদের সাথে মিশে নিজেকে উঁচু ভেবে আত্মতৃপ্তি পায়।ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ার সময় অতীতের গল্প, যুদ্ধের গল্প শোনার জন্য হয়তো একটা পাখির বাচ্চা পাওয়ার আশায়, হয়তোবা পাখির খাঁচা পাওয়ার আসায় সারাদিন ঘুরঘুর  করতাম ছোট্ট দুইটা টিনের চালাঘরের সেই নিস্তব্ধ জঙ্গলাকীর্ণ  বাড়িতে।

দুখু মিয়ার সাথে আমার বয়সী প্রায় সকলেরই গভীর মিল ছিল।আমরা কয়েকজন প্রায়ই বাড়ির উঠোনে পিঁড়ি নিয়ে বসতাম,গল্প শুনতাম,গাছের কোটরে এখন কয়টা পাখির বাচ্চা আছে, এ বছর টিক্কা ময়না পাখিটি কাকে দিবে এসব নিয়ে হরেকরকম আলোচনা চলত। দাদা আগের মতোই অন্যের দেওয়া বাঁশ দিয়ে বেতের বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে যেত বিনিময়ে আরেকটা এক্সট্রা বাঁশ নিত যা দিয়ে  বড় বড় খাঁচা বানিয়ে বিক্রি করাই ছিল তার আয়ের একমাত্র উৎস।গল্প করলে কাজের ব্যাঘাত ঘটে এমন ধারনা করে রান্নাঘর থেকেই বৃদ্ধা মহিলাটি দাদাকে গালিগালাজ করত,আমাদের দিকে এমনভাবে তাকাত যেন চোখের উত্তাপে ভস্ম করে দিবে।পেয়ারা গাছে, জাম্বুরা গাছে অনেক ফল হলেও মহিলার সামনে কিছুই নেওয়া যেত না,যদিও দাদা নেওয়ার জন্য ভয়ে ভয়ে বলত।তবে আমরা যখনই সুযোগ পেয়েছি,হয়তো মহিলাটি আমাদের পুকুরে গোসল দিতে গিয়েছে  বা আমাদের বাড়ি থেকে ছোট কলসি দিয়ে পানি আনতে গিয়েছে,যে যা পেরেছি নিয়ে সোজা ধান ক্ষেতের চিপায়।ধানক্ষেত থেকেই অদৃশ্য চোরদের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ শুনতে পাওয়া যেত।

একদিন তো ধরাই খেয়ে গেলাম,শূন্য বাড়ি দেখে পেয়ারা গাছে উঠেছি, সঙ্গীরা নিচ থেকে কুঁড়িয়ে জমা করছে,হঠাৎ করে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পাছায় দুইটা বাড়ি, নিচে তাকিয়ে দেখি সবাই ধানক্ষেতের চিপা বরাবর দৌড়, আমিও সবার মতো দৌড় দিলাম কিন্তু ধানক্ষেতে না গিয়ে গাছতলায় এক পা মচকে পড়ে রইলাম।হয়তো দৌড় না দিলে এলোপাতাড়ি আরো কয়েকটি কঞ্চির বাড়ি পিঠ বরাবর এসে পড়ত।গালিগালাজ করতে করতে বাড়িতে এসে সোজা বাবার কাছে বিচার!যা হওয়ার তাই হয়েছে,ভয়ে সারাদিন বাড়ির আশেপাশে যায়নি।সন্ধ্যায় ভাল পড়ুয়া ছাত্রের মতো বই নিয়ে পড়তে বসেছি।খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় শুয়ে আছি,আশ্চর্য হলাম যে বাবা কিছুই বলছে না।শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি,বাবা কানে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, পুকুর পাড়ে কবরস্থানের পাশে আন্ধকারে আমাকে বসিয়ে রাখতে।যাওয়ার সময় বাড়ি টার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে গেল,

--এখানে বসে বসে ভাব,ওরা একা বাড়িতে কত কষ্ট করে টিকে আছে।

একথা বলেই বাবা বিদায়!ভাবব কি কবরস্থানের পাশে আছি ভয়েই তো দম শেষ। বাবা যাওয়ার পরপরই মা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ  কিছুই ভাবতে না দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসল।

এর পর থেকেই এই মহিলার প্রতি মনের কোণায় হালকা ঘৃণা বাসা বেধেছিল। তবে ঘৃণাটা চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নিল যখন মুখে মুখে শুনলাম বৃদ্ধা মহিলাটি সুদে টাকা দেয়।একপা গর্তে চলে গেছে আর সে কিনা সুদ খায়,কথাটা মনে হতেই মেজাজটা বিগড়ে যেত।

 স্কুল লাইফ শেষে শহরে কলেজে ভর্তি হলাম। ছুটিতে গ্রামে গেলে মাঝেমাঝেই বুড়িকে দেখা যেত।কাচারি ঘরে বসে আছি,হয়তো মাটির কলস নিয়ে পানি নিতে আসছে,হয়তো মোবাইল নাম্বার নিয়ে আসছে একমাত্র ছেলের সাথে একটু কথা বলার জন্য। ছেলে দুইটা বিয়ে করে মাকে একা ফেলে রেখে ঢাকায় মেকানিক্সের কাজ করে।আমার কাছেও আসে মাঝেমধ্যে, মোবাইল নাম্বার টা হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

--ভাই রে,তোর মোবাইলডা দে একটা মিসকল দেত।মেলা দিন ধইরা ছ্যাড়াডার সাথে আলাপ হয়না।

:মোবাইলে টাকা নাই।অন্যকারো কাছে যান।

সরাসরি না করে দিলাম  টাকা থাকা সত্ত্বেও।উনার মুখের ভঙ্গি দেখে বুঝে ছিলাম বুকে কতটা কষ্ট নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। মহিলাটাকে দেখলেই সুদখোরের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে,তখন উনাকে অসহ্য,বিরক্ত লাগে।দিন যায়, মাস যায় বাড়িতে আসলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও  বিতৃষ্ণা নিয়ে বুড়িকে দেখতে হত।

মেডিকেলে এডমিশনের পড়ার চাপে অনেকদিন বুড়ির কথা মনেও হয় না, দেখাও হয় না।টার্ম শেষে একদিন বাড়িতে কাচারি ঘরে শুয়ে আছি।পুকুর ঘাট থেকে কে যেন ডাকছে,বের হয়ে দেখি বুড়িটি গোসল শেষ করে ঘাট থেকে উপরে উঠতে পারছে না,

--বাবা,একটু হাত ডা ধরবি,উঠতে পারছি না।

আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পেলাম না।বুড়িকে দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে,থরথর করে শীতে কাঁপছে, ভাঙ্গা পুকুর ঘাট দিয়ে উঠতে পারছে না।

:আমার হাত ধরেন।উঠতে পারেন না,এ ঘাট দিয়ে নামেন কেন?

--ভাই রে,ছুডু সময় থেইক্যা তোরার এই  দীঘিতে গোসল কইরা অভ্যাস ।অন্য কোন হানে মন সয় না।

আমি কিছুই বললাম না,সোজা কাচারি ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।যে ভাবনা টা বাবা ৮/৯ বছর আগে ভাবতে বলেছিল,সেই ভাবনাটাই এখন বারে বারে মাথায় চক্কর দিয়ে যাচ্ছে।

বুড়ির স্বামীকে নিজের চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছি।মেয়েরা সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। একটা মাত্র ছেলেও মা মরল কি বাঁচল তার পরোয়া না করে ঢাকায় পড়ে আছে।একদিন আলো ভর্তা ডাল  রান্নাকরলে অনায়েসে ২ দিন পার করে দিতে পারে। ধানের মৌসুমে ক্ষেতে পরে থাকা ,ইঁদুরের গর্ত থেকে বের করে আনা ,আশেপাশের গেরস্তের কাছে পাওয়া কিছু ধান দিয়েই কোনভাবে মাস চলে যায়।৮০ বছরে এসেও কেউ রান্না করে খায় ভাবতেই অবাক লাগে।এর কাছে ওর কাছে পাওয়া অল্প জমানো টাকাকে বাড়ানোর জন্য হয়তো নিরুপায় হয়ে এই খারাপ পন্থা নিয়েছে।আর আমি সমস্ত মানুষটাকে খারাপ ভেবে ঘৃণা করে আসছি!

-- ভাই রে, দিবি একটু নাম্বার ডা ঢুকাইয়া।

হয়তো হাত ধরে পুকুর থেকে তুললাম বলেই মনের সাহসেই নাম্বার নিয়ে ডিরেক্ট রুমে ঢুকে গেল।এখন সত্যিই টাকা নেই,ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স এনে কল দিয়ে মোবাইল হাতে ধরিয়ে দিলাম। যে কাজ টা বহুবছর ধরে করে আসছি,মোবাইলে টাকা নেই বলে ফিরিয়ে দিয়ে ,তার পুনরাবৃত্তি করে উনার মনের পাথর আর ভারি করতে চাই না।

--তুই তো আমরার বাড়িত যাস না,ছুডুবেলার কথায় অভিমান করতে নেই,গরীব মানুস কি থেইক্কা কি কইয়া ফেলছি।

:আরে কি যে বলেন,অভিমান করব কেন!
পড়ার চাপে যাওয়ার সুযোগ হয় না।

"তুই তো আমরার বাড়িত যাস না" কথাটি বারবার মনকে নাড়া দিচ্ছিল।ওইদিন বিকালে দুইবার যেয়েও ফিরে এসেছি।কি একটা সংকোচবোধ পিছনে টানছিল।তৃতীয় বার ঠিকই ক্লাস ফোরে পড়ুয়া ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে আস্তে আস্তে এ বাড়ির দিকে হাঁটা ধরছি।অজানা এক আকর্ষণ আমাকে এখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, জানতে চেষ্টাও করিনি কি সে আকর্ষণ, হয়ত জানতে পারলে পেছপা হয়ে ফিরে আসতে হত।

--ব রে ভাই,ব।কতদিন পর এই বাড়িতে আইছস।
একথা বলেই দুইটা পিঁড়ি আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিল।

:না,দাদু।বসব না।খাওয়াদাওয়া করছ?

--দুইক্ষ্যার লাইজ্ঞা দুইলা হানিভাত রাখছিলাম,চেপা(হিদল) ভর্তা আছে,হে খাইত না, তুই খাইবি?

:মাত্র খেয়ে আসছি।কাঁচা সুপারি থাকলে একটু দেও,পান লাগবে না।
দুপুরে পানি ভাত কেন?রান্না কর নি?

--ভাই রে রানতে ইচ্ছা করে না,কাল সহালে রানছিলাম,এগুলোই খাইতাছি।

:দুইক্ষ্যা দাদা কই?

--হের কথা আর কইস না।সারাদিন ঘ্যানরঘ্যানর করতেই থাকে। এইটুকু একটা ব্যাডা,হে এইডা খাইতো না ওইটা খাইতো না,আমারে একবারে জ্বালাইয়া মারছে।কারো বাড়িতে গিয়েও খাইত না।

কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলতেছে,মনে হয় হের লগে জ্বীন ভূত আছে।রাইত বিরাতে বিড়বিড় করে।
দেখ ওই ঘরের চিপায় পড়ে আছে।

ভাঙ্গা টিনের চালা ঘরের ভিতরে চোখে পড়ে, চৌকির উপর পুরাতন কাঁথা বেছানো,তার পাশেই দাদা শুয়ে আছে,পাটের রশ্মি দিয়ে বানানো দুইটা চিকে তাতে মশলার বোতল রাখা,বাঁশ দিয়ে বানানো হাড়ি পাতিল রাখার তাকিয়া,ছোট একটা কলসিতে অল্প জল।অন্যান্য বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন একা একটা বাড়ি।একটা কলাগাছের বাকল ঘর থেকে বাহিরে সংযোগ দেওয়া,রাতে বাহিরে যেতে ভয় পায় বলে প্রস্রাব করার এই নিঞ্জা টেকনিক।

বুড়ি টাকার হিসাব দিয়ে যাচ্ছে,কার কাছে কত টাকা দিয়ে রাখছে তার হিসাব।যেন একবারে মরার আগে আপন কাউকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
বুড়ি আমাকে অনর্গল তার কষ্টের কাহিনি শুনিয়ে যাচ্ছে।কোন মেয়ে কোন স্বামীর ঘরে কত কষ্টে আছে,ছেলেটা ঈদ আসলেও দেখতে আসে না।কতদিন ধরে ছোট মেয়ের সাথে কথা হয় না!

:নাম্বার দেন,কল দিয়ে দেই।

--না ভাই থাক,হুদাই ট্যাহা নষ্ট অইব।

:মোবাইলে টাকা আছে,আপনি যতক্ষণ খুশি কথা বলেন।

বুড়ি হয়তো কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিল না,যেই আমি মোবাইলে টাকা থাকলেও না করতাম,আর সেই আমি-ই কিনা বুড়ির বাড়িতে গিয়ে নিজে সেধে কল দিতে চাচ্ছি।বুড়ি হয়তো আমার হঠাৎ ভালবাসা হজম করতে পারে নি।আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইছে,আমি কি বলছি তা আরও ভাল করে বুঝার চেষ্টা করছে,বুড়ির চোখের কোণার সিক্ততা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি।

:আপনার যখন মোবাইল করতে মন চাইবে,আমাকে ডাক দিয়েন,আমি মোবাইল নিয়ে আসব,যতক্ষণ খুশি কথা বলবেন।

বুড়ি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিল কিনা আমি জানি না,কারো চোখে পানি দেখলে আমার অসহ্য লাগে,অসহ্য চোখের পানি না দেখেই সেদিন বাড়ি চলে আসলাম।

আগামীকাল থেকে মেডিকেলে ক্লাস শুরু হবে।ব্যাগ গুছিয়ে আজই হোস্টেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিব।এক পা প্যান্টে চালান করলাম মাত্র,পাশের ঘরের ভাবি হাসতে হাসতে বলতে লাগল হুইল্ল্যার মা নাকি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে,২/৩ জনের কাছে খবর ও নাকি পাঠাইছে।বুড়ির কাছে যেতে কেমন অস্পৃশ্য লজ্জা পাচ্ছিলাম তার উপর যাওয়ার সময় আরেক ভাবি হেসেহেসে বলে দিল,

---কি ব্যাপার,বুড়ি রাও আপনাকে খুঁজে।যান যান তাড়াতাড়ি যান।

মোবাইল করতে মন চাইলেই ডাক দিতে বলছি বলে কি এই অসময়ে ডাক দিবে।অনেকটা বিরক্তি নিয়েই মোবাইল সাথে নিয়ে গেলাম,ভাবলাম ছেলের সাথে মোবাইলে কথা বলবে।
রাগের স্বরেই বললাম,

:কি হয়ছে,ডাকতেছেন কেন?কার কাছে কল দিবেন,তাড়াতাড়ি নাম্বার দেন,কল দিয়ে দিচ্ছি।

--দুইক্ষ্যারে দিয়ে তোর জন্য বাজার থেইক্কা  কাঁঠল আনাইছিলাম।আমি ভাইঙ্গা দেই,দুইখান কোষ আমার সামনে বইসা খা।

:না,দাদু।এখন কাঁঠাল খাব না।

--আমরা গরীব বলে খাইবি না,ঘিন্না লাগে নাকি।নে,ভাই তুই নিজের হাতে ভাইঙ্গা খা।

আমার অপছন্দের তালিকায় প্রথমে আছে কাঁঠাল। একথা বুড়িকে কেমনে বুঝাই। তবুও বুড়ির এমন কথায় নিজের অনিচ্ছা কে জলাঞ্জলি দিয়ে বুড়ির হাত থেকে কাঁঠাল নিলাম।বুড়ি থাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে।সে যে কি শান্তি পাচ্ছে সেটা বুঝার ক্ষমতা আল্লাহপাক আমায় দেয়নি। যে মানুষটাকে আমি এতোদিন যাবত ঘৃণা করে আসছি, সেই মানুষটাই নিজে না খেয়ে আমাকে কাঁঠাল খাওয়ানোতে আনন্দ পাচ্ছে।সিক্ত চোখ নিয়ে পালিয়ে আসা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথের অস্তিত্বের কথা আমার জানা নেই।শুধু সেটাই জানি বুড়ির অব্যক্ত ভালবাসার কাছে আমি পরাজিত।

Abdullah Nayon

বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০১৯

     ফিজিওলজি ভাইভা 





                                                                          মেডিকেলে প্রফ দিতে হলে নাকি দেহে বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। সবার মতো আমিও ঘটা করেই কিছুটা ধার দেওনা করে ফরমাল শার্ট,  কালো প্যান্ট,কালো জুতা,পরিষ্কার এপ্রোনের আয়োজন করেছি।তবে আমার আয়োজনটা একটু বেশিই ছিল,রিটেনের একমাস আগে হুট করে মাথা ন্যাড়া করে দিলাম।হিসাবমত ভাইভার আগেই মুটামুটি ভালই চুলের অধিকারীর হওয়ার আশাবাদী। কিন্তু আমি অংকে কাঁচা হওয়ায় কাল্পনিক হিসাবের সাথে বাস্তবিক হিসাবের কোন মিলই পেলাম না।রিটেন শেষে প্রথম ভাইভা দিয়ে ক্যাপ সহিত ঈদ করে পরবর্তী ভাইভা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হোস্টেলে এসে মাথায় হাত দিয়েও চুলের তেমন কোন পরিবর্তন দেখলাম না।

এক্সটার্নালঃ তুমি কি মালয়েশিয়ান?

ভাবতেছি হ্যা বলে দিব, দূরদেশী হওয়ার সুবাধে যদি একটু করুণা পাই।কিন্তু পরপরই মনে হল, মালয়েশিয়ানরা  কোন ভাষায় কথা বলে  নামই জানি না,কথা বলবো তো দূরের কথা।
:না ম্যাডাম,বাংলাদেশী।

--বাসা কোথায়?

:ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ।

ইনটার্নালঃ কাছেই তো।


ফিজিওলজি ভাইভা চলছে।এক্সটার্নাল ম্যাডাম কার্ড দেখে অনর্গল  প্রশ্ন করে যাচ্ছে,আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছি ম্যাডামের সুন্দর মুখখানার দিকে।ভাবছি,এতো সুন্দর মুখ দিয়ে কেমনে এতো  কঠোর ধমক দিচ্ছে।প্রতিটি প্রশ্নই ধমকের সুরে!আমার আগের দুইজনের সময় এক্সটার্নাল ম্যাডাম ফোনে কথা বলছিল,মনে মনে খুব চাইছিলাম আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হওক। হ্যাঁ এমনটাই হয়ছে তবে একটু ভিন্নভাবে,
আমাদের কলেজের ম্যাডাম এদিকে দৃষ্টিপাত না করে অনবরত  কথা বলে যাচ্ছেন একজন জুনিয়র ম্যামের সাথে!

--ADH হরমোনের কাজ বল।

:water reabsorbtion করে।

--তোমার মাথা থেকে করে!

:না,ম্যাডাম। রেনাল টিউব্যুল থেকে।

--স্পেসিফিক পার্টের নাম বল না কেন!

:ম্যাডাম, PCT থেকে।

--PCT তে তো ADH ই ক্ষরিত হয় না।কি বলছ এসব!

:সরি, ম্যাডাম। DCT থেকে করে।

ফাইজলামি কর!একটা না হলে তো আরেকটা হবেই।
--টেস্টোস্টেরনের সোর্স বল।

প্রশ্নটা চেনাচেনা লাগছে তাই একটু জোরেশোরেই ধমকের সুরে বলে ফেললাম ,
:ম্যাডাম,টেস্টিস।
প্রতিক্রিয়া আসবে তবে এতো জোরেশোরে আসবে ভাবি নি,

--টেস্টিস তো এতো বড়, সবটা থেকেই আসে নাকি!টেনে টেনে উত্তর বের করে নেওয়া লাগে কেন?স্পেসিফিক সেলের নাম বল।

:সেলের নাম শুনেই হুট করে বলে দিলাম স্পার্ম সেল।

:কি বললা!!তাহলে লিডিগ সেল থেকে কি আসে?

আন্দাজ করতে পারছি আগের উত্তর টা ভুল ছিল,
:সরি ম্যাডাম,লিডিগ সেল থেকেই টেস্টোস্টেরন আসে।

এবার ম্যাডাম একটু বেশি-ই রেগে গেলেন।
--কি!লিডিগ সেল থেকে টেস্টোস্টেরন আসে!উল্টাপাল্টা যা মুখে আসছে বলে দিচ্ছ।
ম্যাডাম,আপনার ছাত্র এসব কি বলে,লিডিগ সেল থেকে নাকি টেস্টোস্টেরন আসে।

রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।আরেকটা মাত্র সেল বাকি আছে,সার্টোলি সেলের কথা বলে দিয়ে ম্যাডামের হাইপার-রাগন্ত মুখটা দেখার আনন্দ বিঘ্নিত হল ইন্টার্নালের কথা শুনে,

>বাসে জার্নি করে এসে সব গুলিয়ে ফেলেছে।কাছাকাছি বাড়ি তো, বাড়ি থেকে আসে। কথাটা বলেই ম্যাম একটা মুশকি হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকাল।

:জ্বি ম্যাডাম।প্রতিদিন বাড়ি থেকে আসি।এতো সকালে রাস্তায় অটোরিকশা ছিল না।অনেকটা পথ হেঁটে এসে বাসে উঠতে হল।

--কতক্ষন লাগে?

:দেড় ঘন্টা।  ঈদের জন্য ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আসতে হয়ছে।

--বাড়ি থেকে আসো কেন?হোস্টেলে থাকবা,বাড়ি থেকে এতো কষ্ট করে এসে পড়া হয় না।

:জ্বী ম্যাডাম,কাল থেকেই হোস্টেলে উঠব।

--গতবছর কোনটাতে খারাপ করছিলা?তুমি দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিচ্ছো না?

:জ্বি না,ম্যাডাম।আমি জীবনে এই প্রথম প্রফ দিচ্ছি।
 চার আঙ্গুলের কপালে দুইটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করতেছে, এই প্রশ্নটা আগে জিজ্ঞাস করলে হয়তো কষ্টি ধমক গুলো খেতে হত না।

মনটাই খারাপ হয়ে গেল,এতো বাজে ভাইভা দিলাম।আল্লায় জানে এটা ভবিষ্যতে  দ্বিতীয়বার দেখা করার অশনি সংকেত কিনা!তার চেয়ে বেশি অপরাধবোধ হচ্ছিল ম্যাডামকে মিথ্যা বলে আসলাম! মেডিকেল এডমিশনের কোচিং করার সময়  ভাইরা বলত,
"ভাইভাতে স্যার যদি বলে আজকে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে,তাহলে তুমি বলবা জ্বি স্যার আমিও দেখেছি। কখনো তর্ক করতে যেও না।" সেটার বহিঃপ্রকাশ এমন করে হবে ভাবিনি।

মনে মনে অনেক যুক্তি দাঁড় করালাম,আমি তো মিথ্যা কিছুই বলি নি।সকালে রেডি হয়ে হোস্টেল থেকে হেঁটে বাঘমারা মোড়ে গেলাম ডিম পরোটা খাওয়ার উদ্দেশ্যে,আগের দিন ম্যাডাম বার বার বলে দিসিল,একটা ডিম দুইটা পরোটা না খেয়ে কেউ ভাইভা তে এসো না।পরে অটোরিকশা নিয়ে গেলাম কলেজ ক্যাম্পাসে।যাওয়ার সময় অটোরিকশা থেকে দেখলাম বাস ভর্তি লোক দাঁড়িয়ে আছে চলন্ত বাসে।কয়েকদিন আগেই তো ঈদের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে আসলাম।আংশিক পাপ মুক্তির আনন্দ শিরায় শিরায় আন্দোলিত হচ্ছে।

আবদুল্লাহ নয়ন

সোমবার, ১৩ মে, ২০১৯

ক্রাইস্ট চার্চে ক্রিকেটার



ভিডিও গেইমের কোন ক্যারেক্টার মাল বেশি খাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস্তব জগতে চলে আসছে।
অচেনা জগতের সবকিছু তার অচেনা। কোথায় যাবে সে?
বাস্তব জগতের কিছুটা রেশ সে অনুভব করতে পারছে,সে বুঝতে পারছে এক জায়গায় বেশিক্ষণ  দাঁড়িয়ে থাকলে চলমান মানুষ গুলো তাকে বোকাচোদা ভাববে।সেও যে মাথায় মাল নিয়ে ঘুরে এটা দেখাতে হবে না?
সে টা দেখানোর জন্যই ক্রাইষ্টচার্চে দুটি মসজিদে ঢুকে গেলো,যেখানে কি না বাংলাদেশের ক্রিকেট দল থাকার কথা ছিল!!!১,২,৩.....৪৯++++ট্রস ট্রস করে গুলি চলছে,রিয়েল মানুষ মারার আনন্দ সে বুঝে গেছে!!!!
তাকে পর্দার আড়াল থেকে দেখে আরও শত শত ক্যারেক্টার অনুপ্রাণিত হবে,তারা কি চাইবে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে??সময়ের দাবি....

আজ যদি ঠিক এই ক্যারেক্টার ই ভুল করে ফুল স্পিডে  কোন গির্জায়,মন্দিরে ঢুকে যেত,দেয়াল থেকে জাস্ট একটা ইট খসে পড়তো ;  পরিস্থিতি কি হতো?

একই ঘটনা যদি নিউজিল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশে ঘটতো,পরিস্থিতি কি দাঁড়াতো?

চিন্তা করা যায়?????

আত্মকথন





যখন আমি পিচকু ছিলাম,মেডিকেল কি জানতাম না।তবে এটা জানতাম,যারা ডাক্তার তারা অন্য কোনো গ্রহ থেকে ছিটকে পড়া অতি মানব টাইপের কেউ।।যারা কিনা প্রসবের পরে,দমবন্ধ হওয়া বাবা-মায়ের প্রথম বাবুটিকে পায়ের গোছা ধরে সাড়ে বারোটা চক্কর দিয়ে কাঁদিয়েছিলো। ক্লাস টেন অবধিও আমি জানতাম না,,আবুল হাসান,গাজি আজমল স্যারের বই পড়ে অতিমানব হওয়ার সূচনা করতে হয়।

যখন জানলাম,ভিনগ্রহ থেকে ছিটকে পড়া বস্তুটি কি এবং সাধারন মানুষ কিভাবে এমন বস্তু হতে পারবে...তখনই ..

হ্যাঁ,ঠিক তখনই,আমার মনের গহীনে অদৃশ্যমান জ্ঞানশূন্য ঘরে আশার বালুকনা পিলার বাধঁতে শুরু করলো।

ডাক্তার!!
শব্দটা শুনলেই বুকের বামপাশে ছ্যাঁত করে উঠে,এই যেন আরেকটা পিলার হয়ে গেলো!বুকের ধুকধুকানি বাড়তে লাগলো,পড়ার চেয়ারে হেলান দিয়ে, চোখ বুজে থেকে, কল্পনায় এপ্রন গায়ে দিয়ে ক্লাস করার ভিসা পেয়ে শীতল সুখে চেয়ারেই গভীর ঘুমে এলিয়ে পড়লাম,যাতে কোনো দিন সেই ক্লাস শেষ না হয়!!
হ্যাঁ,ভিসা আমি ঠিকই পেয়েছিলাম,কিন্তু এপ্রন গায়ে দিয়ে নয়,বাকৃবি র পুকুরে। (fisheries in BAU)
গায়ে এপ্রন পড়ার যে বালুকা ঘর তোলার জন্য পিলার বানিয়েছিলো,তা একবারে ভেঙ্গে যায় নাই।লেগে গেলাম চুনকাম করার জন্য।( 2nd time dite)

মেডিকেলের কোনো বড় ভাই/বোনকে হঠাৎ দেখতে পেলে,একদৃষ্টিতে ক্ষুদার্ত পাখির ছানার মত তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে, তার ভিতরে কি যেন খুঁজতাম,সে যেনো সোনার খনি তার ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে,যা দিয়ে আমার অন্তরের কম্পন কমাতে পারবে।(হঠাৎ করে কেউ আমার এ তাকানো দেখতে পেলে বলতো,ছিঃ! বদ নজর দিয়ে তাকিয়ে আছে!!)

কিন্তু হায়!যখন এপ্রন পড়ার ভিসা আমার হাতে উপরওয়ালা ধরিয়ে দিলো,তখন ভাই/আপুরা দূরে থাক্, নিজের দিকেই তাকানো ইচ্ছা করে না!

এটাই যেনো চলমান জগতের প্রবাহমান ধারা,রহস্যময় মানুষগুলোকে জানতে ইচ্ছা করে,তাদের মত নিজেকে কল্পনা করতে পারাও যেনো জন্মকে সার্থক মনে হয়,,কিন্তু নিজে যখন রহস্যের একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে রহস্যের চেয়ায়ে তার জায়গা দখল করে নেয়,তখন সব আগ্রহের ইতি ঘটে।।

রবিবার, ১২ মে, ২০১৯

মন বারান্দায়


প্রথম পর্ব।


---দেখ্ মামা,পা একবারে আমাদের পায়ের কাছে নিয়ে আসছে।চল লাগিয়ে দেই।
:স্যার বুঝে যাবে।
---আরে,স্যার তো ম্যাথ করাচ্ছে।টেবিলের নিচে বুঝতে পারবে না।
:লামিয়া যদি চিৎকার করে উঠে,হুলস্থুল কাণ্ড হয়ে যাবে। 
---গর্দভ,তোর দ্বারা কিছুই হবে না বলেই জহির লামিয়ার পায়ে ওর পা দিয়ে চিমটি খাটলো।
মাইনাস ফোর পাওয়ারি চশমার কাঁচ ভেদ করে আমার দৃষ্টি বিদ্যুৎের গতিতে সরে যাওয়া একটা পা দেখতে পেল।আমি বার দুয়েক স্যারের দৃষ্টির আড়ালে জহির আর লামিয়ার দিকে থাকালাম,কোন ভাবান্তর নেই!আমি বসছিলাম স্যারের পাশে, আমার পাশে জহির সহ আরও চারটা ছেলে ,আমাদের বিপরীতে একই টেবিলে চারটি মেয়ে পাশাপাশি বসেছে।নবম শ্রেণীতে উঠার শুরু থেকেই আমরা নয়জনের একটা গ্রুপ পাঁচ মাস যাবত স্যারের কাছে পড়ে আসছি। মেয়েরা যাওয়ার কয়দিন পরে আমরাও পড়তে গেলে স্যার এক ব্যাচ ই  সবাইকে পড়াত।কিন্তু কোন ছেলে কোন মেয়ের সাথে কথা বলার সাহস পেত না,যদিও একই স্কুলে পড়তাম।সত্য বলতে কি ওরা এই স্যারের কাছে পড়ছে বলেই আমরা ও শুরু করছি। ওদের আকর্ষণেই প্রাইভেটে যাওয়া।কিন্তু ওদের সাথে কথা বলতে অজানা একটা বাঁধা কাজ করত। ওরা যেন ভিন্ন গ্রহের ভিন্ন ভাষার প্রাণী।তবে মনে মনে সব মেয়ে/ ছেলেই চাইতো,ইস যদি ছেলেদের/মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারতাম।একটা মেয়ের সাথে সামন্য কথা বলা বিরাট ব্যাপারস্যাপার ছিল।জহির টাইপের কোন ছেলে যদি হঠাৎ করে কোন মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাস করার  সাহস দেখাত ,কেমন আছো?হয়ে গেছে, ওই ছেলেকে নিয়েই ক্লাসের সব ছেলে মাতামাতি শুরু করে দিতো।

জহির ছেলেটা ডানপিটে,শয়তানিতে মাস্টার্স করা,আমিও বিদ্যাটা রপ্ত করার ধান্ধায় আছি ,সালামি হিসাবে ২ টাকার একটা পালস  দিলেই সে মহাখুশি।তবে এ বিদ্যাটা সবার চেহারার সাথে যায় না,শত চেষ্টা করেও আমার চেহারায় মানিয়ে নিতে পারি না।কেমন কেমন একটা ইনুসেন্ট ভাব থেকেই যায়। তার কারন ও আছে,আমি ইচ্ছা করলেও ওর মতো সবার সামনে থেকে নারিকেল চুরি করে পালাতে পারবো না।ক্রাশের সাথে কথা বলতে গিয়ে মেয়ের বড় বোনের ঝাঁটার দুলাই থেকে রক্ষার জন্য দৌড়াতে পারব না। কিছু ছেলে আছে মনের ভিতর শত শয়তানির ইচ্ছা থাকলেও,বাহিরে তাকে ভদ্রই দেখাবে।আমি হলাম তেমনই পিচ্চি টাইপের রাঙ্গা চেহারার নিরীহ লাজুক ভদ্র ছেলে। পিচ্চি হলেও ক্লাস রোল এক হওয়ার সুবাধে সবার সুনজরে ছিলাম,অনেকের কাছে অবশ্য ছোটভাই।

লামিয়াকে দেখা যাচ্ছে অনেকটা দূরে,সাথে আরও দুইটা মেয়ে,কুয়াশা ভেদ করে আসছে ‘কারপ্যু   স্যারের’ ম্যাথ প্রাইভেটে। স্কুল থেকে কয়েকমিনিটের হাঁটা পথ।সোনালী কার্প মাছের সাথে মিল বলে সবাই এই নামেই জানে,বাবা মায়ের দেওয়া ভাল নামটা মনে হয় না কেউ জানে,কেউ জানার প্রয়োজনও মনে করে না।পৃথিবীর সবাই অন্যকে নিয়ে মজা নিতে পৈশাচিক আনন্দ পায়, নামি-দামি মানুষ হলে তো কথায় নাই।আজকে ইচ্ছা করেই স্যার থেকে দূরেই বসছি,জহিরের সাথে প্ল্যান করা,আমি পা দিলে মেয়েটি রিয়েকশন দেখব, খেয়াল রাখছি কখন পা এদিকে আনে। পড়া প্রায় শেষের পথে হঠাৎ কালো একটা পা ঠিক আমার জুতার সামনে  নাড়াচাড়া করছে।বুক ধড়ফড় করছে,কখনো কোন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলাম না।কি যে হবে! জহির অনবরত চিমটি কেটে বুঝিয়ে দিচ্ছে,শালার ব্যাটা এখনো বসে আছিস কেন?আমি যে ভীতু না,তার প্রমাণ দিতে হবে।অন্যমনস্কের ভান ধরেই পা টা একটু এগিয়ে দিতেই ওর পায়ের সাথে লেগে গেল।আমি খুব মনোযোগী হওয়ার ভান করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি।কিন্ত আশ্চর্য হলাম কয়েক সেকেন্ড বাদেই,যখন দেখলাম মেয়েটি পা সরানোর কোন চেষ্টায় করছে না।যখন তিন/চার মিনিট ওর পায়ের উপর পা রাখার পরেও পা নেওয়ার কোন নাম নিচ্ছে না,তখন রীতিমতো আমি ভড়কে গিয়েই পা সরিয়ে  নিয়ে আসছি।
 প্রাইভেট শেষে সরাসরি স্কুলের মাঠে পি.টি তে যোগ দিলাম।সবাই যে কেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে বুঝতে পারলাম না,কাকে যেন আমাকে ইশারা করে বলতে শুনলাম;
দেখ,উপরে উপরে যতই না করুক,তলে তলে ঠিকই টেম্পু চালাচ্ছে।
হঠাৎ করে পি.টি স্যারের কথা শুনে আকাশটা মাথায় না ভাঙ্গলেও উপরের নারিকেল গাছটা যে ভেঙ্গেছে সেটার নিশ্চয়তা দিতে পারি;

কিরে,সাকিব?দুই পায়ে দুই-রঙের জুতা কেন?
সবাই হো হো করে হেসে দিল।জুতা দেখে তো আমার মাথাচক্কর দিয়ে উঠছে।এটা কিভাবে সম্ভব! 

__দেখ্,তোর লামিয়া তোর জুতা নিয়ে গেছে।

:আমার লামিয়া মানে!

জহিরের পৈশাচিক আনন্দে বাঁধা দেওয়ার কোন অধিকার আমার নেই।যদিও বাহিরে বাহিরে একটু বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতাম,কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিজেও সেই আনন্দের স্বাদ আস্বাদন করতাম।লামিয়ার রোল সবসময়ই দুই থাকে। তার উপর আমার মত পিচ্চি হোক না সে একটু কালশিটে।দুইজনেই ভাল পড়াশোনা পারতাম বলেই হয়তো কালশিটে হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুদের ঠাট্টায় অনিচ্ছায়  মনের কোণায় ভাবনার একটা অস্থায়ী জায়গা তৈরী হয়ে যেত।

আজকে ক্লাসে কি হবে একথা চিন্তা করতেই এখুনি স্কুল পালাতে ইচ্ছা করছে,কিন্তু এটা সম্ভব না।পি.টি শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাংলা স্যার ক্লাস নিতে চলে আসছে।ক্লাস চলছে,যতটা আশা করছিলাম তার কিছুই অঘটন ঘটে নাই,শুধু মাত্র কয়েকটা ছেলেমেয়ের মুচকি হাসি ছাড়া।  কিন্তু ক্লাস শেষে যেটা হলো সেটার জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না।

আমাকে নিয়ে সব ছেলেই মশকরা করবে, স্বাভাবিক।লামিয়াকে নিয়ে মেয়েরা মাশকরা করবে তাও,স্বাভাবিক।হ্যাঁ,তাই ঘটতেছে।কিন্তু যে মেয়েরা ক্লাসে কোনদিনই ছেলেদের সাথে কথা বলে নি, কথা বলা যেখানে বিশ্ব জয় করার সমতুল্য।হঠাৎ কি এমন হয়ে গেল! আজ সেখানে মেয়েরাই ক্লাসের অন্যসব ছেলেদের সাথে চুপিচুপি কি-সব বলেই হাসাহাসি করছে।তাহলে কি এতোদিন যাবত সবার মনেই একটা অব্যাক্ত বাসনা ছিল,যেটা দরজা খুলে বাহিরে বের হতে পারছিল না,বের হওয়ার দরজা খুঁজছিল,আমার সামান্য জুতা বিনিময় ই কি সেই দরজা খুলে দিয়েছে!   হঠাৎ করে  রুম নিস্তব্ধ,ভাবলাম যাইহোক না কেন  একটা ভাল কাজ ই হয়ে গেছে।এবারের মত তো এঘটনা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নিস্তব্ধ রুমের নীরবতা ছারখার করে  সবাই যখন সোল্লাসে বলা শুরু করল,

দুলাভাই….

আমার কান্না চলে আসছে,ছুঁইলাম না ধরলাম না,দুলাভাই!
সামন্য জিনিস গড়িয়ে গড়িয়ে এতোটা চলে আসবে বুঝতে পারি নাই,বুঝলে আরও আগেই থামিয়ে দিতাম।এমন ইনার-পিস  উপভোগ করতাম না।
 ক্লাস শুরু থেকেই পিছনের বেঞ্চে নীরবে বসে থাকা  নীরা নামের মেয়েটি রাগে গরগর করতে করতে,

---জুতা বদল হয়ছে তো কি হয়ছে,প্রেম এতো সোজা নাকি।সাকিব কি কখনো বলছে যে লামিয়াকে ভালবাসে?তোরা শুধু শুধু ওদের নিয়ে মাতামাতি করতেছোস কেন?
কথাগুলো এমনভাবে বললো যে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সবাই চুপ হয়ে গেল।কেউ কিছু বুঝতে পারল না,নীরা  হঠাৎ এমন করল কেন?ক্লাস শুরু থেকেই খেয়াল করলাম সে আনাদের মজা নিয়ে কোন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে না,বরং রাগে মুখের আকৃতি এমন করে রাখছে,যেকেউ দেখলে ভয় পেয়ে বলে দিবে,’থাক বাবা,আমি আর ওদের নিয়ে মজা নিব না।’

 স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি তার একটা চোখ নষ্ট, কখনও কথা বলি নি।তবে এক চোখ নিয়েই মেয়েটিকে আমার দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকতে দেখতাম।  নীরার চোখের কোণে পানির অস্থিত্ব আমি অনুভব করছি।
   

চলবে….

আবদুল্লাহ নয়ন 

কাঁচা আউশ

                                  

          

       এক।




হিরনের কাছে আজ সবকিছু বেসামাল লাগছে।লাগার কথাই,শুক্রবার মানে তার জন্মদিন বলে কথা।প্রসববেদনায় কাতর আয়শা বাথরুমে পিছলে পরে আছে,বাসায় কেউ নেই,একটা পা ভেঙ্গে গেছে,দরজা খুলে বাহিরে বের হওয়া অসম্ভব। মায়ের অন্ধকার ক্ষুদ্র কুপ থেকে বের হয়ে আলোর বদলে বাথরুমের বিশ্রী গন্ধ শুকে সে চিৎকার করে জানিয়েছিল, মা আমি বেঁচে আছি। সেই  থেকে শুক্রবার তার জীবনের আলাদা অধ্যায় হয়ে যায়।         
   
 হাফপ্যান্ট পড়া পিচ্চিটা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কেন্?ও  কি তার অপমানের কথা বুঝতে পেরেছে?আর যারা ওই ঘটনা না দেখছে তাদেরকে   বলে দিবে?
এইমাত্রই তো ঘটনাটা ঘটলো, এইতো বিকালবেলা, এখনো তো সে বাড়িতে যায় নাই,এখনো তো সূর্যদেব তার আলো নিভিয়ে দেয় নাই,এর মাঝেই সবাই জেনে গেছে?এইতো গতকালেই তো এসময় মেয়েটি তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিলো,আজ হঠাৎ করে সব ঘোলাটে হয়ে গেলো কেনো?এই ধোঁয়াটে, নিষ্ঠুর রাস্তায় আর এক মুহূর্তও  দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না।সে হনহন করে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো,মনে হচ্ছে রাস্তার চারপাশ থেকে উৎসুক জনতা তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।রাস্তার দুপাশের ধানক্ষেত গুলাও যেন হেসে হেসে বলছে,বাক্কারে ব্যাটা!

বাড়িতে ঢুকেই তার পা আটকে গেলো,চারদিক তাকিয়ে দেখে নিলো,কেউ তাকে দেখে ফেলছে কি-না। না,কেউ তাকে দেখছে না।সে বাড়ির পিছনদিক দিয়ে বিড়ালের মত পা ফেলে তার ঘরে ঢুকে গেলো। সবেমাত্র দরজার ছিটকিনি আটকিয়ে,বালিশে মুখ গোজে চোখ বন্ধ করে শুয়েছে, এমন সময় বাবার কথা শুনে আঁতকে উঠলো,

...তোমার ছেলেকে পশ্চিম পাড়ায় ঘুরাঘুরি করতে  মানা করো।

:আজব তো!এই বয়সে একটু ঘুরাঘুরি করবে না?

...পড়ার নামে খবর নেই,সারাদিন আতরামি ফাতরামি করে বেড়ায়।ডাক্তার হওয়া  সোজা কথা না।তাড়াতাড়ি হোস্টেলে যেতে বল।

:দেড়মাস পর আসছে,বরিশালে থেকে থেকে ছেলের শরীরটা একবারে কি হয়ে গেছে!বলেই আয়শা ডুকরে কেঁদে উঠে।

আয়নাল সাহেব কোনোকিছু তেই ভয় পায় না একমাত্র আয়শার কান্না ছাড়া।সেই ষোলো -সতেরো বছর বয়সে বাবা-মা, আভিজাত্য সব বিসর্জন দিয়ে তার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলো।লজ্জায় আর কোনোদিন বাড়িতে ফেরার চিন্তা করে নাই।চিন্তা করে নাই বললে ভুল হবে,কতদিন জানালার পাশে বসে আকাশের সচল মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেঘ ঘন থেকে ঘনতর হয়,আকাশের বুক ছিঁড়ে বৃষ্টির ফোঁটা অনবরত ঝরে পড়ে,তার চোখেরজল স্রোতস্বিনী নদীর নকশা অঙ্কন করে।সেই চোখের জলে তার বাবা-মা,ভাই-বোনদের স্নেহ ভালোবাসার স্মৃতি আয়নাল সাহেবের চোখে ঝলসে উঠে।সে তার সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে কিন্তু ওই ভালোবাসা দেওয়ার ক্ষমতা তো সৃষ্টিকর্তা  তাকে দেয় নাই।

হিরনের বুঝতে দেরি হয় না  কাকে নিয়ে কথা হচ্ছে।এসব কথা শুনার ইচ্ছা তার নেই,দরজার ছিটকিনি খুলে আস্তে আস্তে বাড়ির পিছন দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
বাড়ি থেকে বের হয়ে হিরন পুকুরপাড়ে বসে আছে।নামমাত্র পাতা নিয়ে সজিনা  গাছটা ব্যার্থতা স্বীকার করে পানির উপর নুয়ে পড়েছে ।পাশাপাশি দুইটা কাঠাঁল গাছে দুইটা বুলবুলি একে অপরের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।পাশের কদমগাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা টুনটুনি পাখি এটা উপভোগ করছে। হিরন দুই কাঠাঁল গাছের মাঝে বসে  নীরব সাক্ষী  হয়ে আছে। গৌরবর্ণের চেহারায় সন্ধ্যার লালাভ আলো পড়ে তার মুখের আদ্যপ্রান্ত সব  জানিয়ে দিচ্ছে।কাছে গেলে বুঝা যায়,কে যেন তার মুখে সুঁই দিয়ে অসংখ্য গর্ত করে দিয়েছে,যদিও দূর থেকে কারও বুঝার উপায় নেই। দুইএকটা হালকা তিলের ছিটা মুখের সৌন্দর্যকে না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। মোটামুটি  মাংসল শরীর নিয়ে মহা ঝামেলায় আছে কেননা উচ্চতার তুলনায়  চওড়া দেহকে একটু বেশিই চওড়া মনে হয়।মনে হয় না ইহজন্মে কখনো চুলের যত্ন নিয়েছে, সামনে পিছনে সমান চুল গুলি কান আবৃত করে আছে; যত্নের অভাবে চুল গুলি তার নিজস্ব রং পরিবর্তন করে  ধূসর হয়ে যাচ্ছে,এদিকে খেয়াল করার সময় তার নেই কারন তাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। গ্রামের এই ভদ্র, নম্র,সহজ সরল স্বভাবের ছেলেটি মেডিকেলে এসে অনুভব করেছে ,তার ভোঁতা অনুভূতিগুলো ক্রমশ  ধারালো হচ্ছে।

দেড়/দুইমাস আগের ঘটনা এখন সে মনে করতে চাচ্ছে না কিন্তু কেন জানি এটাই বারবার মস্তিষ্কের পিছনে অক্সিপিটাল লোবে আঘাত হানছে। কেননা,কেউ যদি আপনাকে বলে,আপনার অমুক ভাবিকে ‘না-দেখে’ পাঁচমিনিট চোখ বন্ধ করে থাকতে পারবেন? আপনি সাথে সাথে বলে দিবেন,হ্যাঁ পারবো।কিন্তু বন্ধ করলে দেখা যাবে এই পাচঁমিনিটে আপনি তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হদিস পেয়ে গেছেন!ওই যে ‘না-দেখে’ অনিচ্ছাটা আপনার স্পর্শ ইন্দ্রিয়র উপর কল্পনার জাল বুনে কৃত্রিম সক্রিয় ইন্দ্রিয় সৃষ্টি করে দিবে।

ব্যার্থতাকে মেনে নিয়ে অতিরিক্ত একবছর ঘরের কোণায় লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জলে বই ভেজানো ছেলেটি দ্বিতীয় বার সিঁড়ি পাড়ি দিতে গিয়ে পড়ে যায় নি।এবার আর তাকে ঘরে আটকে রাখার সাধ্য কারো নেই।খাঁচাছাড়া পাখির মতো এ গ্রাম,ও গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে।হিরন কোন এক শুক্রবারে  জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে, বিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে, দেউরী ঘেরা একটি বাড়ি থেকে বের হওয়া বৃষ্টিভেজা কাদাময় কাঁচা রাস্তাটি দিয়ে আনমান হয়ে হাঁটছিল।হঠাৎ করে তার পায়ের সাথে অন্য একটি মাংসল পায়ের ল্যাং মারার অস্থিত্ব অনুভব করে,আর নিজেকে আবিষ্কার করে কাদাময় গর্তে দুই পা ছড়িয়ে আরামে বসে আছে।আর তার পাশে  মাঝারি আকৃতির,ছিপছিপে গড়নের,প্যান্টশার্ট পড়া একটি মেয়ে,ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট হাতে নিয়ে,বিড়ালের মত চোখে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে তাকে খুঁটিয়ে খঁটিয়ে দেখছে,আর ফিকফিক করে অনবরত হেসে যাচ্ছে। মেয়েটির চোখ হিরনের চোখে পড়তেই হিরন লজ্জায় অন্যদিকে ঘুরে গেলো,
---“কি মশায়,আপনি কি এভাবেই হাঁটেন?এত অল্পতেই পড়ে গেলেন! দেন,হাত দেন।” বলে মেয়েটি তার হাত বাড়িয়ে দিলো।

প্রথম দেখায় কারো প্রেমে পড়ে যাওয়া পাগলামির লক্ষন।লোকে শুনলে পাগল উপাধি দিয়ে সামাজিক দায়িত্বের খাতিরে  পকেট ভেঙ্গে আপনাকে দিব্যি পাবনায় দিয়ে আসবে। এমনকি হিরনও স্বাচ্ছন্দ্যে এ  গুরুদায়িত্বটুকু পালন করতো।কিন্তু শুক্রবার বলে কথা,হিরনের বিরুদ্ধে যাবে না,তাও কি হয়? 

স্কুল মেইড নিলয়ের কল্যানে মেয়ের নাম,ঠিকানা জানতে দ্বিতীয়দিন অপেক্ষা করা লাগে নাই।সেদিন থেকেই বন্ধু নিলয়কে নিয়ে প্রতিদিন বিকালবেলা পাঁচ গ্রাম পেরিয়ে কাঁচা রাস্তাটির পাশে শিমুলগাছের গুঁড়িতে  বসে আড্ডা দিতো।দূর থেকে প্রায়ই দেখা যেত,ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ডে ইয়ারে পড়ুয়া কেয়া বাচ্চাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে।সে চোখকে ঘুরিয়ে বিভিন্ন  এঙ্গেলে (কখনো ৪৫°,কখনোবা ১৮০°)মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো।যখন কেয়ার চোখের সাথে তার চোখ এক সরলরেখায় এসে যেত,হয়ে যেত তাদের মধ্যে চোখাচোখি, হাসি বিনিময়।ঠিক তখনই, হীরনের ভোঁতা  অনুভুতি গুলো প্রাণ ফিরে পেতো।
হয়তোবা কোনদিন কেয়া খেলায় আসলো না,তার চোখ চলে যেত বাড়ির দেউড়ী ভেদ করে,কোনকিছুর নাড়াচাড়া অনুভব করলেই, বুকের ভিতর কেমন যেন ধক্ করে উঠতো।

   দুই পাটি দাঁত বের করে হি হি হা হা করে হাসতে হাসতে নিলয় বলতে লাগলো,
--- কি কাকা!ব্যাপার কি?আজকাল মেয়ে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলা,কেয়ার ভিতর কি দেখলা?

লজ্জায় হিরনের মুখ রক্তিম হয়ে গেলো।
সে জানে না।আসলেই সে জানে না।মেয়েটির চঞ্চলতা?চটপটে স্বভাব?  তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসি দেওয়া?চোখের চাহনি? নাকি অন্য কিছু? তার মনে জায়গা করে নিয়েছে,সে কিছুই জানে না।
চিরপরিচিত সেই বাড়ি,বাড়ির পাশের কাঁচা রাস্তাটি দিয়ে হাঁটছে,পিছনে পেলে আসছে রাশি রাশি ধূলিকণা।সাদাটে ধূলিকণা কে বিদীর্ণ করে তার  সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি পিছনে ফিরে বাহির বাড়িতে কাউকে দেখতে পাবার আশায় শিমুলবীহিন শিমুলগাছের ছায়ায় দুই বন্ধু  বসে আছে।কিন্তু চার/পাঁচ দিন যাবত মেয়েটির কোনো হদিস পাওয়া গেলো না!
সূর্যদেব যখন তার রথে চড়ে পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে গেলো,ঘরে ঘরে জ্বলে উঠা সন্ধ্যাবাতির ঝিলিক যখন তাদের  চোখে এসে পড়লো;তখন অপেক্ষার প্রহর শেষ করে, আস্তে আস্তে মন খারাপের রথে চড়ে ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে যোগ দিতে বরিশাল চলে আসল।

                             দুই।


এরপর হিরন প্রায় মাস দেড়েক পর ১০ দিনের অটো নিয়ে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে আসে।তার মনের জমানো শত কোটি অনুভূতির প্রকাশ করতে সে দেউরীর ফাঁক দিয়ে উঁকঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু কারো কোন দেখা পাচ্ছে না।কাছাকাছি থেকেও পাচঁ/ছয় দিন যাবত কেয়াকে দেখতে পায় না!
এটা সে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেছে না।মনে হচ্ছে পৃথিবীপতি যত কষ্ট পৃথিবীতে বিলিয়ে দিয়েছে,সব যেন তার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে।এক একটা দিন,মুহূর্ত তার কাছে এক একটা বছরের মত লাগছে।না আছে ঠিকমত খাওয়া, না আছে নাওয়া, ওকে দেখতে পাবার  আশায় কত সকাল,কত দুপুর,কত বিকাল; শিমুলগাছ,বটগাছের  ছায়ায় কাটিয়ে দিয়েছে,তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

---কিরে,কিছুদিন ধরে তুই আনমনা হয়ে ঘুরতেছিস,কিছু হয়েছে?

মুখে ভাত নিয়ে,জানালার বাহিরে তাকিয়ে,ভাতের থালায় এলোমেলো অক্ষর আকঁছে।মায়ের কথায় সে চমকে উঠে-

:কই কিছু হয় নাই তো।

---তো,মুখে ভাত গোজে দিয়ে বসে আছিস কেন?

:কলেজ তো ০২ তারিখ খোলা,আর চার/পাঁচ দিন পরে চলে যেতে হবে।তাই বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে।

ছেলের কথা শুনে মায়ের চোখে পানিজমতে শুরু করছে।সে জানে এখন গেলে দেড় দুই মাসের আগে আর  একমাত্র ছেলেকে দেখতে পারবে না।তবু ছেলের সামনে সে চোখের জলে বুক ভেজাতে চায় না।নীরবে কিছুক্ষন কেঁদে না নিলে, তার কষ্ট কিছুতেই কমবে না। সামনে বসে অপলক দৃষ্টিতে ছেলের খাওয়া দেখছে,

---তোর কাকার বিয়ে ঠিক হয়েছে এপ্রিলের ২৯ তারিখ, জানিস তো?

---হুম।

---তুই তো আর আসতে পারবি না?

---এসময় আমার পরীক্ষা থাকবে।

---তুই আসার কিছুদিন আগে মেয়ে দেখা হয়েছে।মেয়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অনেক সুন্দরী।

মেয়ে দেখা হয়েছে কিনা,কোথায় দেখা হয়েছে,মেয়ে কেমন, কোথায় পড়ালেখা করে;এসব সে শুনতে চায় না।তার মাথার এখন কেয়া চড়কির মতো ঘুরছে। ওকে ছাড়া সে কোনোকিছুই ভাবতে চায় না।সবকিছু তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।মেয়েটি তার স্বপ্নে আসে স্বপ্নকুমারী হয়ে,দুইদিন আগেও তো সে স্বপ্নে দেখেছে,
মেয়েটি এসে তার হাত ধরে বলতেছে,এই ভ্যাবলা ছেলে,তুমি প্রতিদিনেই আমার পিছনে ঘুরঘুর করো কেনো?লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারো কেনো? কিছু বলবে?তুমি কি আমায় ভালবাসো?তাহলে আসো আমরা পালিয়ে যাই,আমার না কারো সাথে পালিয়ে যাওয়ার অনেক সখ।কোনো কথা নাই বার্তা নাই,ওরা পালিয়ে গেল গহীন কোনো জঙ্গলে।গভীর নির্জন জ্যোৎস্না রাতে,তারা হাত ধরাধরি করে চাঁদের দিকে চেয়ে হাটছে,আকাশে কোটি কোটি,একটা একটা তারা গুনছে আর সামনে অগ্রসর হচ্ছে ,সবগুলো তারা গুনে শেষ করার আগে কোন ক্ষমতা নেই তাদের হাতকে আলাদা করার,হঠাৎ একটা আরশোলা দেখে কেয়া চিৎকার করে হিরনকে জড়িয়ে ধরলো।মেয়েটিকে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে যাবে ;এমন সময় মসজিদ থেকে ভেসে আসছে,'আসসলাতু খাইরুম মিনান নাউম।'চোখ মেলে হিরন দেখে,একটা আধমরা  আরশোলা তার  বুকের উপর বিলি কাটছে।

ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু হিরনের অপেক্ষার প্রহর শেষ হবার নয়। অলৌকিক ভাবেই মনে হয় গতকাল কেয়াকে সাইকেল চালিয়ে কলেজ থেকে আসতে দেখেছিল।কেয়া তার দিকে চেয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল!

আজ শুক্রবার,তো কি হয়েছে।আজকেই একটা কিছু করতে হবে।সে ঠিকই মোশাররফ স্যারের হাইয়ার ম্যাথ প্রাইভেট থেকে সাইকেলিং করে আসবে।আশেপাশে কোথাও লালগোলাপ পাওয়া যাচ্ছিলো না,হিরন কেয়ার বাগান থেকেই ফুল চুরি করে এনেছিলো৷ নিলয় চৌরাস্তার মাথায় দাঁড়ানো, নিলয়ের কল পেয়ে হিরন সাইকেলে পেডেল দিলো,কিছুক্ষন যেতেই বিপরীত দিক থেকে মেয়েটির সাইকেল দেখতে পেল।কথা ছিলো ওর সামনে জোরে ব্রেক করবে,কিন্তু হঠাৎ করে তার চোখে  চোখ পরতেই বুকের ভিতর ধক্ করে উঠল।আর চোখ ফেরাতে পারল না। হিরনের সাইকেল টা পাশের পুকুরে পড়তে গিয়েও যেন  পড়ল না।

---কি,মিস্টার?টাস্কি খেলেন নাকি?কথাগুলা বলেই মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে।

হিরন দ্বিধায় পড়ে গেলো।কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না।
:না,মানে.....এ...

---অনেকদিন  ধরে দেখছি,আপনি আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করেছেন। ব্যাপার কি?চুরি  করার ধান্ধা নাকি?একথা বলে সে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হিরন চুরি করা  লাল গোলাপ ফুলটা বুক পকেট থেকে নিয়ে মালিকের বুকের সামনে ধরে, দম টেনে ভয় কাটিয়ে  আমতা আমতা করে দীর্ঘক্ষন যাবত প্র‍্যাক্টিস করা বুলি আওরাতে  শুরু করলো,
:অনেক দিন ধরে ভাবছি এটা আপনাকে দিব,কিন্তু দেওয়ার সুযোগ হয়ে উঠছে না।এটা গ্রহন করলে কৃতার্থ হবো।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ফুলটি নিলো, অনেক সময় নিয়ে গন্ধ শুকলো,
---ফুলের গন্ধটা ভাল,মনে হচ্ছে আমার বাগানের।আপনার নাম হিরন,না?
কথাগুলো বলে মিটিমিটি হাসছে।

হিরন যেন আকাশ থেকে গাছের ডালে পড়ে চ্যাংদোলা খেয়েছে,মেয়েটি তার নাম জানলো কিভাবে!নাম জানা কি তার কথা!সে তাকে চিনে!!!
:হুম,আপনি জানলেন কিভাবে?

---জানতে হয় মশায়,আপনার কাকার নাম জেনো কি?

কাকার নাম!!হিরনের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে,কোথা হতে অন্ধকার এসে তার চোখ বুজিয়ে  দিচ্ছে,অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বললো,
:ডা.ইলিয়াস

নামটি শুনেই হিরনের দিকে চোখ টিপে মিটিমিটি হেসে সাইকেলে পেডেল দিলো।

হিরন শুধু নির্বাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে সচল সাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিশাল ডিম্বাকার পৃথিবী ক্রমশ সরু হয়ে অসীম  রাস্তা হয়ে যাচ্ছ, আর সে রাস্তায় সাইকেল চলছে অসম্ভবের পথে।সে পথে পাড়ি দেওয়ার সাহস তার ইহজন্মেও হবে না।


আবদুল্লাহ নয়ন 





ক্ষুদ্র দৃষ্টি